২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

দাদার কয়েনের সিন্দুক

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-

আমি পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বড় বোনের বয়স যখন প্রায় দুই বছর, তখন আমার জন্ম। আমার ছোট আরো দুই ভাই আছে। ওরা একজন আমার থেকে আড়াই বছর, আরেকজন সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট। জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি দাদার রুমের চৌকির অপর পাশে একটা বড় বাক্স। সবাই বলে এটার নাম সিন্দুক। আরেকটু বড় হওয়ার পর জানতে পারি, ওই সিন্দুকে নাকি পরিবারের সব দামি জিনিস আছে। কেউ কখনোই ওই সিন্দুক খুলত না, একমাত্র দাদা ছাড়া।
একদিন বড় বোন নীলাকে দেখছি গল্পের বই পড়তে। তখন আমি অল্প অল্প পড়তে শিখেছি। আপাকে জিজ্ঞেস করিÑ
আপা এটা কী বই পড়ছো।
বই ঠিকই, কিন্তু স্কুলের নয়। এটা গল্পের বই।
আমায় পড়তে দেবে।
তুই আরেকটু বড় হলেই পড়তে পারবি।
তাহলে আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ো, আমি শুনি।
আমি গল্পের বই জোরে পড়তে পারি না। তুই দাদাকে বলিস, দাদাই পড়ে শোনাবে।
দাদা আমাদের অনেক গল্প শোনাতেন। বই পড়েও শোনাতেন। এমনও দিন গেছে, দাদা বাড়ির সব শিশুকে নিয়ে গোল হয়ে বসে গল্প শুনিয়েছেন। দাদার পেশা ছিল শিক্ষকতা। এখন তিনি অবসরে, এই অবসরকে কাজে লাগাতেই তিনি বিভিন্ন কাজ করতেন।
সেদিন আপার কথাটা আমার ভালো লাগেনি, কী হতো আমাকে একটু শোনালে। দেখলাম ও পড়ে আর হাসে। আপা বই রেখে উঠে যায়। আমি বই নিয়ে বানান করে পড়তে শুরু করি। ওপরে নাম লেখাÑ ‘সিন্দাবাদের সিন্দুক’। তখনি দাদার সিন্দুকের কথা মনে পড়ল। বইটা বানান করে পড়তে খুব কষ্ট হবে, কিন্তু সিন্দুক লেখা, এটা কি দাদা আমাকে পড়ে শোনাবে?
নাহ! নিজেকেই পড়তে হবে। আপা স্কুলে গেলে আমি এটা পড়তে শুরু করি। খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে বানান করে পুরো বই পড়ে ফেলি। বইয়ের লেখাগুলো বড় অক্ষরের ছিল। নিজেও পড়ে অনেক হেসেছি। সিন্দুক সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। বুঝলাম সিন্দুকে দামি সম্পত্তিই থাকে। থাকে সোনা, গয়না, হীরা, জহরত। বইয়ে লেখা ছিলÑ সিন্দুকে বড় তালা দেয়া থাকে, একটার ভেতর আরেকটা থাকে, তাতেও তালা দেয়া থাকে। কিন্তু দাদার সিন্দুকে কোনো তালাই দেখিনি। আবার দাদা ছাড়া কেউ খোলেও না।
একদিন দাদীকে জিজ্ঞেস করিÑ
দাদী, দাদার সিন্দুকে তালা দেয়া নেই কেন?
দাদী খুব হেসে জবাব দেনÑ
যেই সিন্দুক তার আবার তালা।
কেন? ওখানে যে দামি জিনিসগুলো আছে, কেউ যদি নিয়ে যায়।
দামি জিনিস! তোর দাদার সিন্দুকে কয়েন ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
কয়েন?
কেন? তোর জন্যও তো আছে কয়েন।
তুমি যে কি কও দাদী, আমাকে আবার কে দেবে কয়েন?
শুধু তোর নয়, নীলার আছে, রাজনের আছে, অয়নেরও আছে। তুই দেখিসনি রাজন আর অয়ন হওয়ার পর ওদেরকে যে কয়েনের বাক্স দেয়া হয়েছে।
দাদী, ও দাদী; আমি কয়েনের বাক্স দেখব।
না মৌ, তা হবে না। সময় হলে তোর দাদাই দেখাবে।
একদিন দাদা আমাদের গল্প শোনাতে বসেন। আমি দাদার পাশেই বসে চুপে চুপে বলিÑ
দাদা, আমাদের কয়েনের বাক্সের গল্প শোনাবে।
দাদা চুপে চুপে বলেনÑ
আজ এখানে নয়, অন্য দিন তোকে শোনাব।
সেদিন আকাশটা খুব সুন্দর। আকাশের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে এমন করে ওদের উড়তে দেখি। আমি রোজ গুনতে থাকি। প্রতিদিন কয়টা গুনতে পারি, তা গিয়ে দাদাকে বলি। আজ অনেক বেশি গুনেছি। দাদাকে গিয়ে বলাতে তিনি আমাকে গল্প শোনাতে চান। দাদা বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই দেখেছিÑ বাবা-মা একটা পিতলের কলসে কয়েন জমা করেন। বড় হওয়ার পর আমাকে দেখিয়ে বললেনÑ ‘যদি কোনো দিন খুব বিপদে পড়িস, এখান থেকে নিস।’ অল্প বয়সে বাবা-মা চলে যান না-ফেরার দেশে। আমি অনেক কষ্ট করেই লেখাপড়া করি। স্কুলের মাস্টার হই। কিন্তু এই কয়েন খরচ করিনি। বিপদে পড়লে এসে কলসের মুখ খুলে আমি তাকিয়ে বাবা-মাকে মনে করতাম। আল্লাহ আমার বিপদ সারিয়ে নিতেন। আমার তিন সন্তান হয়েছে, তাও এগুলো কিছুই করিনি। যখন বউমা, মানে তোর মা বউ হয়ে এ ঘরে আসে, তখন ভেবেছি আমার নাতি বা নাতনী যারাই আসবে, তারাই মালিক হবে এই কয়েনের।
যেদিন খবর পেলাম নীলা তোর মায়ের পেটে, সেদিন একমুঠো রাখলাম আলাদা বাক্সে, এরপর বাজার করলে যেকোনোভাবেই হাতে কয়েন এলে তা ওই বাক্সে রাখতাম। নীলা হওয়ার পর ওর মুখ দেখেছি সেই বাক্স দিয়ে। তোর বেলায়ও তাই করেছি। রাজন, অয়ন তোদের সবার জন্যই আছে।
দাদার কথাগুলো শুনে আমি চুপ হয়ে ছিলাম।
Ñকিরে শুনেছিস তো।
Ñদাদা এগুলো দিয়ে আমরা কী করব?
Ñতোদের যা ইচ্ছা। জমা করতে পারিস, খরচ করতে পারিস, যা ইচ্ছা।
যখন আমার বয়স ১৩-১৪ বছর, তখন দাদা খুব অসুস্থ হন। দাদা নিজেই সিন্দুক খুলে সবার কয়েনের বাক্সে সবাইকে দেন। যার যে বাক্স তাতে তার নাম লেখা আছে। দাদা আমাদের এগুলো খুলে দেখতে বলেন। আমরা খুলে দেখি। সবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। এত শুধু টাকার কয়েন নয়, এখানে একটা করে সোনার কয়েনও আছে। দাদা নিজেই জানতেন এখানে টাকার কয়েন রাখা। কিন্তু তা নয়, এই কয়েনের সাথে সোনার কয়েন আছে।
কয়েক দিন পর দাদা না-ফেরার দেশে চলে যান।

 


আরো সংবাদ



premium cement