২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এক টুকরো গোশত   চারাগল্প

-

কাল বাদে পরশু ঈদ-
রাবির মায়ের দু’চোখ খুশিতে চিকচিক করছে!
গরুর গোশতের এত দাম যে, বহু দিন ধরে এক টুকরো মুখে পড়েনি! রাবির বাবা ও তার ভাই রাফু, ঈদের হাট করতে যাবে বলে রাবি সওদার লিস্ট করে। অসুস্থ মা ঘর থেকে উঁকি মেরে টানা গলায় বলে, ‘ও রাবি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মসলা লিখে দিস মা, পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজন তো গোশত দিয়ে যাবেই।’ রাবি সওদার লিস্টে দরকারি সব লিখে তা ভাইয়ের হাতে দেয়।
মায়ের ওষুধপথ্য কিনতে প্রতি মাসে যা টাকা যায়, তাতে ভালোমন্দ কিছু কেনা বা খাওয়া হয় না অনেক দিন ধরে! বাড়িতে দু’টো মোরগ ছিল, সেই মোরগ বিক্রি করেই আজকের বাজারটা চলবে।
ক্রমেই রাফু ও তার বাবা মোরগ বিক্রি করে ওষুধপাতিসহ টুকিটাকি বাজার করে ঘরে ফেরে।
পরদিন মা রাবিকে বলে, গোশত রান্নার জন্য যাতে মসলা-টসলা আগেই সুন্দরভাবে বেটে রাখে।
রাবি, মায়ের কথামতো সব ঠিকঠাক করে রাখে।
ঘরে ঘরে মহা আনন্দ, ঈদ আনন্দ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পটকা ফুটায় খুশির উল্লাসে। আকাশে বাতাসে আনন্দ ফুলকি ঝরে।
দলে দলে চেনামুখ ঈদগাহে যায়, সবার চোখেমুখে কি অপরূপ হাসি,আতর গোলাপ সুরমা আর নতুন পোশাকে সুষমাময় এক সকাল।
রাবির হাতে বানানো জায়নামাজ কাঁধে চেপে রাফু ও তার বাবা ঈদগাহ যায়।
রাবি রুটি বানানো শুরু করে, ভাই ও বাবা ঘরে ফিরলেই রুটি সেমাই খেতে দেবে। সেই সাথে ভাত ও সবজিও রাঁধে। রাবি জানে, রাফুটা মোটেও রুটি পছন্দ করে না, উৎসবগুলোতে নামে মাত্র মুখে দেয়। আর বাবার অভ্যাস যতই এটা সেটা খাওয়া যাক না কেন, ভাত তার লাগবেই।
ঈদের নামাজ আদায় করে রাফুরা বাড়ি ফেরে।
রাফু, ভাত খেতে খেতে বলে, বুবু আজ সবার ঘরে ঘরে গোশত রুটি, আমি কিন্তু রুটি খাবো না, গোশত দিয়েই পেট ভরে ভাত খাবো। রাবি ভাবনা মুখে মলিন হেসে বলে, তা তো খাবিই, কেন খাবি ন...? সূর্যের চিবুকে বিমূর্ত সুখের শিরোনাম স্বপ্ন সে তো সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
বিকেল আসে স্নিগ্ধতায়। মা রাবিকে ডেকে বলে গোশতের জন্য পেঁয়াজ কেটে রাখতে। রাবি বুঝতে পারে মায়ের খুব গরু গোশত খেতে ইচ্ছে করে। আর করবে না বা কেন, সেই কবে খেয়েছিল খালার বাড়িতেÑ
একের পর এক ঝামেলা লেগে থাকার জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি গোশত কেনার। রাবি মনস্থ করে কয়েক বাড়ি থেকে গোশত এলেই মায়ের জন্য রান্না করবে, মাকে ভালোভাবে রুটি গোশত খাইয়ে তারপর নিজেদের কথা ভাববে।
রাবি বসে থাকে বারান্দায়,খুব ইচ্ছে করে একটু বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আরাম ঘুম দিতে। কিন্তু কেউ যদি গোশত দিতে এসে ফিরে যায়, এ ভেবে বাইরে বসে থাকে।
এদিকে তার মাও কান পেতে থাকে কেউ আসছে নাকি গোশত দিতে। খালপাড়ার দিলবাহার, গান গাইতে গাইতে আসে রাবিদের বাড়ি গোশত দিতে। রাবির নীরব নিঝুম মন চঞ্চল হয়ে ওঠে খুশিতে।
এদিকে মা রাবিকে বারবার ডেকে বলে, ওমা কতটা গোশত দিয়ে গেল দিলবাহার, নিয়ে আয় দেখি, একটু দেখিরে মা, একটু দেখি!
রাবি ঘরে এসে মাকে গোশতের টুকরো কয়েক দেখায়Ñ
তার মধ্যে দুটো অজংগা হাড়, আর এক টুকরো জিহ্বার অংশ ও এক টুকরো গোশত।
মায়ের মুখ মুহূর্তের মধ্যে বিমর্ষ আঁধারে একাকার হয়ে যায়!
রাবি বুঝতে পারে মায়ের মন ভাঙার অবস্থা। সে মাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য জোর করে হেসে বলে,
‘ওমা আরো তো অনেকেই গোশত দিতে আসবে, মন খারাপ করো না তো।
পুরনো বাড়ি থেকে তো এখনো দেয়নি, এখনই দিতে আসবে দেখ।’
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাবির ভাবনাটা বেশ ভারী হতে থাকে, মাকে কী রান্না করে দেবে, কী বলবে?
ঘোর ভাবনায় দিলবারের দেয়া গোশত টুকরো অগণিতবার নাড়তে নাড়তে সারা দিনের ক্লান্তিতে টলে পড়ে রাবি।
হঠাৎ পুরনো বাড়ি থেকে মেঝো চাচার ডাক, ও রাবি। রাবি...
গোশতটা নেতো মা, বাড়িতে ছিলাম না তাই বেলাতে দিয়ে যেতে পারিনি। তোরা নতুন বাড়িতে আসার পর থেকে তেমন দেখা সাক্ষাৎ, কথা বলা হয় না। যা হোক গোশতটা নে। একটা মাত্র ভাগ, ছোট গরু, বেশি গোশত হয়নি। তাই বেশি দিতে পারলাম না, মা। এ বলে চলে যায়।
রাবি চাচার দেয়া গোশত দেখে কেঁদে ওঠে!
এ কয়েক টুকরো শুধু, আবার গোশত না, হাড়!
রাবিরা কারো কাছে হাত পাতার মতো গরিব নয় যে, হাত পেতে এক টুকরো গোশত চাইবে কারো কাছে। প্রতিবার কোরবানি দিত কষ্টশিষ্ট করে। কিন্তু তার মায়ের অসুখে বেশ অর্থ গেল এবার, আবার পুরনো বাড়ি ভেঙে বাইরে এসে বাড়ি করতে হয়েছে, পুরনো ভিটে বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা ও নতুন বাড়ির কাজে ব্যয় করা হয়েছে। রাবি বিকেলে দেখেছে অনেক ভিক্ষুকের হাতে দুই থেকে তিন কেজি গোশত, পলিথিন ব্যাগে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওরা তুলেছে।
তাই তার মনে বড় অভিমান বার্তা, অভিযোগে তোলপাড় দেয়Ñ গরিবের গরিব যারা, তাদের ঘরেও আজ অনেক গোশত! রাফু পেটপুরে গোশত দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে। আর মা! মা যে চেয়ে আছে এক টুকরো গোশত মুখে দেয়ার প্রত্যাশায়, মধ্য শ্রেণীর খবর বুঝি এ যুগে কেউই রাখে না!
বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও


আরো সংবাদ



premium cement