১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছেলেবেলার কোরবানি

-

কোরবানির ঈদের আর কয়েক দিন বাকি। আমি, সোহেল, সাঈদ, আনিস ও আবদুল্লাহ আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ার পর মনে রাজ্যের আনন্দ নিয়ে নাওতলা কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলাম। আমরা তখন নাইনে পড়ি। টেনের সাথে খেলা হবে আজ। যেটা ভাবতাম সেটাই তখন করা চাই আমাদের। আমাদের খেলা শুরু করার সাথে সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সাঈদ স্কুল ড্রেস খুলে কোমরে বেঁধে নিলো, সে প্রথম বল করবে। আহারে! বৃষ্টিতে মাখামাখির সে সময়গুলো কোথায় হারিয়ে গেল।
খেলা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি নানা বাড়িতে থাকি। বইগুলো রেখেই আমি আর তাজু মসজিদের ঘাটলায় গোসল করতে নেমে গেলাম। সাঈদরা যে যার বাড়ি চলে গেছে। দু’জনে পানিতে নেমে আছি।
তাজু বললÑ আরে কাল তো রোববার কোরবানির প্রথম হাট, যাবি?
- যামু না মানে, অবশ্যই যামু।
-চল সিনেমা দেখি আসি কাল। বারোটা থেকে তিনটা তারপর সোজা কোরবানির হাটে।
-আমার কাছে টাকা নাইরে দোস্ত।
-তুর টাকা লাগব না, আমি দেবো।
শুনেছি নানা গরু কিনবে আগামী বুধবার। নানা একাই কোরবানি দেন। তাজুরা কোরবানি দিতে পারত না বলে আমার মন খারাপ লাগত খুব। কেন? সে ‘কেন’র উত্তর খুঁজতে গিয়ে তখন নিজেকে অপরাধী মনে হতো। মামাদের সাথে গরু কিনতে যেতাম কিন্তু তাজুকে তখন বললেও আমার সাথে যেত না। আমার এই ব্যাপারটা ভালো লাগত না। গরু বাড়িতে আনার পর তার জন্য খড় আনতে যেতাম পাশের বাড়ি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। কোরবানির আগ পর্যন্ত তাকে চোখে চোখে রাখতাম। সন্ধ্যার আগে খেলার মাঠ থেকে আসার পর তাকে একনজর না দেখলে যেন পুরো পৃথিবীই বৃথা। কোরবানির আগের রাতে নাকি গরু স্বপ্নে দেখে তাকে জবাই করা হবে! সে কথা ভেবে পশুরা কেঁদে ওঠে। কাল ঈদ। সে দৃশ্য দেখার জন্য আমি আর তাজু অধীর আগ্রহে ছুটে গেলাম তার কাছে। এখনই মাগরিবের আজান দেবে এমন অবস্থা। তাজুর চোখে পানি! আমার চোখ ছলছল করে উঠল। সেদিন সত্যিই এই পশুটির ভেজা চোখ দেখে আমাদের কচি মনে দাগ কেটে গেছে খুব। সে দাগের অস্তিত্ব এখনো আমি টের পাই।
ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি এলাম। মসজিদের ইমাম এক রক্তমাখা বিশাল ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি পাশের বাড়ি থেকে গরু জবাই করে এসেছেন। এবার আমাদেরটার পালা। আমরা শেষবারের মতো একবার তাকে দেখে এলাম, আদরও করলাম। জবাই করার সময় সামনে থাকিনি। গোশত কোটাকুটি চলছে। এর ফাঁকে নানা কলিজাটা ভাগ করে একটা অংশ এবং কিছু গোশত রান্নার জন্য দিয়ে দিতেন। নানী ও মামী আগে থেকেই মসলা বেটে রেডি করে রাখত। আমি সবার আগে মামীর কাছে চলে যেতাম; কারণ আমাকে সবার আগে খেতে হবে। রান্নাঘরের সামনের দেয়ালের কারণে কেউ আমাদের দেখছে না। সবাই ব্যস্ত। তাজুকে বললামÑ যা, আকতার ও বেলালকে ডেকে নিয়ে আয়। মামীও আমাকে অনেক আদর করতেন। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারতেন। সে এক পেয়ালা গোশত দিয়ে বললেন- যা, পাক ঘরের পিছনে চলে যা, দেখিস তোর নানী যেন না দেখে। তাজুদের গোশত খাওয়াতে পেরে নিজেকে একটু হালকা লাগছে যেন। তাজুদের সাথে গোশত খাওয়ার সেদিনের দৃশ্য এখনো আমি প্রতিটি ঈদে মিস করি খুব। ইচ্ছে করে আবার জীবনের ওই পিছনের হাটে চলে যাই। একটা পেয়ালা আর কয়েকটা হাত, সবার চোখে-মুখে অন্তরের নির্মল হাসির ঝলকানি; সে তুলনায় হোটেল মিয়ামি আমার কাছে কিছুই না।
নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement

সকল