২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিচারবহির্ভূত হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিচ্ছবি

-

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না। সমাজে বসবাসকালীন মানুষ ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত বা অভ্যাসগতভাবে অন্যায়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। আর যখন সে অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী সে শাস্তি পাবেÑ এটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। অর্থাৎ একজন অপরাধী অপরাধ করলে সে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবে, সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারবে। এমনকি নানাবিধ প্রয়োজনীয় সুবিধা আদালতের সন্তুষ্টিক্রমে আবেদন করতে পারবে। কেননা এগুলো তার আইনগত অধিকার। এমনকি এই অধিকার মানবাধিকারের আওতায়ও পড়ে। মানবাধিকার বলতে বোঝায়; মানব পরিবারের সব সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার, যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ এবং চর্চা করবে। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার এবং এটি সব মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার।
মানবাধিকারের সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি, মানুষ যদি কোনো অপরাধ করে এবং সেই অপরাধের দরুন সে অভিযুক্ত হয়, তা হলে সে আদালতের সম্মুখে তার অপরাধ সংঘটনের মূল কারণ দর্শানোর সুযোগ পাবে। এ অধিকার যে হরণ করবে বা হরণের চেষ্টা করবে সে আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে।
স্বাভাবিক নিয়ম হলোÑ রাষ্ট্র অভিযুক্তকে শাস্তি দেবে। তবে রাষ্ট্র সাধারণত শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার সরকারের তিনটি অঙ্গের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বিচার বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো বিভাগ অভিযুক্তকে শাস্তি দিতে পারে না। সুতরাং বিচার বিভাগ সুনির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশীয় আইন অনুযায়ী অভিযুক্তকে শাস্তি দেবে। সাধারণত বিচার বিভাগ মামলা নিষ্পত্তির শেষে আসামিকে দণ্ড দিয়ে থাকে। কেননা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি অধিকারের প্রশ্ন বা দায় নিরূপণ করা আদালতের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর যখন বিচারের আগেই বা দেশীয় আইনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে অভিযুক্তকে হত্যা করা হয় তখন তাকে বেআইনি হত্যা বলা হয়। এটি আইনবহির্ভূত। একে আবার বিচারবহির্ভূত হত্যাও বলা হয়। আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিত্যঘটনা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে এক প্রকার বেআইনি হত্যাকাণ্ড, যা সাধারণত অপরাধীকে রাষ্ট্র প্রদত্ত আইনত বিচারের আগেই হত্যা করা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যা সাধারণ মানুষের কাছে ‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরূপ হত্যাকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নাম দিয়েছে। এই ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার’ নামে বহু নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ধারণা হলো ব্যক্তিগত ঈর্ষা বা রাজনৈতিক ঈর্ষার কারণে অনেক সময় এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের বয়সের সমান। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ কথা প্রথম বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০০২ সালে। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে অভিযান চালানো হয়েছিল। এই অভিযানে মারা যায় ৫৭ জন। পরে ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩ করা হয়’। (সূত্র : প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০২০)। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট দায়মুক্তির সেই আইন বাতিল করে দেন। সেই রায়ে বলা হয়, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকারী। আমরা মনে করি, যৌথবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।’
সম্প্রতি ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রের’ দেয়া তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে দুই হাজার ৬০ জন। এই সংস্থা আরো তথ্য দিয়েছে যে, এই বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ২০৭ জন। মানবাধিকার সংস্থার ‘অধিকার’ দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে অপহৃত বা গুমের শিকার হয়েছে ৫০৪ জন। এই সংস্থা আরো তথ্য দিয়েছে; গত দুই দশকে চার হাজার দু’জন মানুষ বিনা বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে। আজ যারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় না এনে মেরে ফেলার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে ‘ক্রসফায়ার’ একটা সমাধান দেয় বটে, কিন্তু এটি চলতে দেয়া যায় না। এটি সংবিধান ও আইনপরিপন্থী।
একজন অভিযুক্তকে যখন আদালত কর্তৃক গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তাকে কিভাবে গ্রেফতার করা হবে তার বিধিবিধান আইনে বর্ণিত আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারামতে; ‘কথা বা কাজের মাধ্যমে আসামি আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ অফিসার তার দেহ স্পর্শ করতে পারবেন। এমনকি কোনো আসামির পলায়ন রোধ করতে পুলিশ যেকোনো যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে, তবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় নয় এমন কোনো অপরাধের জন্য কোনো আসামিকে মৃত্যু ঘটানো যাবে না।’ একই আইনের ৫০ ধারাতে আবার বলা হয়েছে; ‘কোনো আসামির পলায়ন রোধ করার জন্য যতটুকু যুক্তিসঙ্গত বাধা দেয়া উচিত তা অপেক্ষা অধিক বাধা দেয়া যাবে না। সুতরাং ওই আইনের ধারা থেকে সহজেই অনুমেয়, গ্রেফতার করার সময় আসামিকে হত্যা করা যাবে না। এমনকি তাকে এমনভাবে বাধা দেয়া যাবে না, যাতে সে মৃত্যুর মুখে ধাবিত হয়। ক্রসফায়ারের শিকার টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুলের কথা আমরা নিশ্চয় ভুলে যায়নি। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাও বেশ আলোচিত হয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ আইন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’-এর ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩ (১) এবং ৩৫ (১, ৩, ৪, ৫) অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, তা বহাল রেখে ক্রসফায়ার ঘটতে পারে না। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে; ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং প্রত্যেকে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘আইনের আশ্রয় লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার’। ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না’। ৩৩(১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না এবং ওই ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’। ৩৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘অপরাধ সংঘটনের সময় যদি কোনো ব্যক্তির বিচার সাধারণ আদালতে করা যেত কিন্তু পরবর্তীতে আইন করে যদি তাকে সামরিক আইনে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।’ ৩৫ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।’
একইভাবে ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না’। ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা, নিষ্ঠুর, অমানসিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না’। এ অনুচ্ছেদগুলো থেকে আমরা বলতে পারি, সংবিধানের প্রত্যক্ষ বরখেলাপ সত্ত্বেও বিচারবহির্ভূত হত্যা নামক হত্যা অব্যাহতই রয়েছে তা নয়, এখন অবধি এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তদন্তের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ও ৪৯১ ধারাতে যে বিধিবিধান সন্নিবেশিত হয়েছে সে বিধিবিধান পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয় হয়, এ ধারাগুলোতে অপহৃত বা গুম ও হয়রানিমূলক গ্রেফতারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি একজন ব্যক্তি যদি মনে করে তাকে অযথা গ্রেফতার করা হয়েছে, তা হলে সে বা অপর যেকোনো ব্যক্তি তার গ্রেফতারের কারণ জানতে চেয়ে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন রিট করতে পারবে। যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আইন ‘সংবিধান’ ও অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন ‘ফৌজদারি কার্যবিধি’ বিচারপূর্বক হত্যাকে নিরুৎসাহিত করছে, সেখানে আমরা কী করে যে প্রাণ দিতে পারি না সে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছি?
বিচারের আগেই অভিযুক্তকে মেরে ফেলা কোনো সমাধান নয়। বরং এর অন্তরালে প্রকৃত দোষীরা পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। বরগুনায় বহুল আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়ন বন্ড। তাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়। নিশ্চয় এই নয়ন বন্ড এক দিনে এ পর্যায়ে আসেনি। তাকে অপরাধ করতে অন্তরাল থেকে কেউ না কেউ সাহস জুগিয়েছে। এসব অন্তরালের লোকজনের কারণেই হাজারও নয়ন বন্ড তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমরা সাজা দিচ্ছি কাকে? আমরা কি ওই সব অন্তরালের লোকদের শাস্তি দিতে পেরেছি? পেরেছি কি তাদের চার দেয়ালের মাঝে আটক রাখতে? নিশ্চয়ই আমরা তাদের প্রকৃত শাস্তি নিশ্চিত করতে পারিনি বলেই একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করে বিগত কয়েক বছরে যে হত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছে অতিদ্রুত সেগুলো তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এসব যখন বাস্তবিকপক্ষে নিশ্চিত হবে, তখনই অপরাধ প্রবণতা কমে দেশ হবে সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী। হ
শিক্ষার্থী : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
abujar.gifary.5614@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর

সকল