২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লাইব্রেরিটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?

-

‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে করেছেন হালাল, সুদকে করেছেন হারাম।’ আল্লাহর এই বিধানকে কায়েম করার জন্যই ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৮ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। সেখানে ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় পর্যায়ক্রমে নিজস্ব অর্থব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ওই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করেছে। ১৯৮১ সালে মক্কা ও তায়েফে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ এবং ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় নিজস্ব অর্থঅবস্থা প্রবর্তন করার প্রস্তাব করে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এ জেড এম শামসুল আলম ছিলেন একজন সচিব। সাধারণত সচিবরা আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ। কিন্তু শামসুল আলম ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গণমুখী জনকল্যাণধর্মী কাজের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন। সরকারি বিভিন্ন পদে তিনি যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই গণমুখী জনকল্যাণধর্মী কাজের ছাপ রেখে এসেছেন। তিনি যখন সমবায় দফতরের নিবন্ধক ছিলেন, তখন সমবায় দফতরের বিশালতা, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এর বিস্তৃতি সর্বোপরি সমবায় দফতরের জনসম্পৃক্ততা তার নজর কাড়ে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি সমবায় একটি তৃতীয় বিকল্প অর্থব্যবস্থাও। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এ দফতরে ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি হলে সমবায় দফতর অধিকতর সংগঠিত ও সক্রিয় হবে এবং জনগণ এর ব্যাপক সুফল ভোগ করতে পারবে। এ ভাবনা থেকে তিনি সমবায় দফতরে একটি ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করে দফতরকে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকারকে প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবমতো সরকার সমবায় দফতরে একটি ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করে। সমবায় ক্যাডারের মাধ্যমে সমবায় দফতর এখন অধিকতর সুসংগঠিত ও সক্রিয়। সমবায় ক্যাডারের সদস্যরা বিসিএসভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গর্ববোধ করে থাকেন।
তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য নিয়াজ মোহাম্মদ খান (এনএম খান) সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বুক সোসাইটির শাখা চট্টগ্রাম, ঢাকা ও করাচি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এ প্রতিষ্ঠানটির ভগ্নদশা দেখে শামসুল আলম সমবায়ের নিবন্ধক হয়ে এর দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন। ভগ্নদশা থেকে পুনরুদ্ধার করে প্রতিষ্ঠানটিকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন। পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটির উত্তরসূরি, বর্তমানে বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি ঢাকা ও চট্টগ্রামে দু’টি বিশাল শাখা গড়ে তুলেছে, যার সদস্য (শেয়ারহোল্ডার) সংখ্যা সহস্রাধিক। দেশ-বিদেশের বইমেলায় প্রতিষ্ঠানটি অংশগ্রহণ করে থাকে। গঠনমূলক সৃজনশীলতা ও কাজের বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি সংস্থা হয়েও ‘কেন্দ্রীয় সংস্থা’র মর্যাদা ভোগ করে এই প্রতিষ্ঠান। এর কৃতিত্বমূলত শামসুল আলমের যিনি এখনো এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
একজন সিএসপি অফিসারের সর্বোচ্চ পদোন্নতি সচিব পর্যায়ে। অবসর গ্রহণের পর কেউ বিশ্বব্যাংকে, কেউ বিদেশে চলে যান, কেউ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রেও শামসুল আলমের চিন্তা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি অবসর জীবনে জনকল্যাণমুখী কাজের স্বাক্ষর রাখার চিন্তা করলেন। কর্মহীন মাদরাসা ছাত্রদের কর্মসংস্থানের কথা ভেবে তিনি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করলেন, যাতে মাদরাসার ছাত্ররা চাকরি করতে পারবেন। চাকরির শেষপ্রান্তে এসে সরকারের কাছ থেকে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে নিলেন। পরিচালনা পরিষদ গঠনকালে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ এবং নিরলস পরিশ্রম করেন।
শুধু টাকাওয়ালাদের কাছে নয়। শিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের কাছেও ব্যাংককে পৌঁছাতে হবে। ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সাথে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যাপক আবদুল গফুর প্রমুখ ভাষাসৈনিকদের সংস্পর্শে এসে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সভাপতিও ছিলেন বহু দিন। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকে ধরে রাখার পাশাপাশি শিক্ষিত সমাজ এবং লেখক, গবেষকদের মাঝে ব্যাংককে জনপ্রিয় করার জন্য আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লাইব্রেরি’ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাংকের বার্তা পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করেন। লাইব্রেরি ও একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আল-আরাফাহ ব্যাংকের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার মৌলিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা ছিল তার।
তোপখানা রোডের চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থল এই লাইব্রেরির অবস্থান। প্রায় ২২ হাজার দেশী-বিদেশী গ্রন্থসংবলিত আরাফাহ ব্যাংক লাইব্রেরিতে আরবি, ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, ফারসি, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষায় রচিত তাফসিরুল কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি, ইসলামী আইন, সিরাত গ্রন্থ, নবী রাসূল সাহাবি, তাবেয়ি, ইমাম, আউলিয়ায়ে কেরাম, বিজ্ঞান, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবনী গ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, কমপিউটার সাইন্স, আধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিজ্ঞানভিত্তিক অসংখ্য রেফারেন্স, শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি, বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়া, বিভিন্ন ভাষার ডিকশনারি, এলমে তাসাউফ, লাইব্রেরি সাইন্স, ইসলামী দর্শন, শিক্ষা ও গবেষণা, ভূগোল, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, উইমেন স্টাডিজ, ভাষা, ইসলামী ও অন্যান্য (বাংলা, ইংরেজি, আরবি উর্দু) উপন্যাস, সাহিত্য এবং ডকুমেন্টারি বিভিন্ন অডিও ভিডিও প্রকাশনা সংরক্ষিত রয়েছে।
এই লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে অনেক জ্ঞানীগুণীর জন্ম হয়েছে। অনেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। নিজেও এখানে লেখাপড়া করে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। হঠাৎ সেদিন গিয়ে দেখি, পুস্তকগুলো স্তূপ করা হচ্ছে। কী ব্যাপার? জবাব এলো, হাজারীবাগে যাবে এসব বই। তার মানে লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? কর্মচারীরা নীরব। জানতে পারলাম, সত্যিই লাইব্রেরি ও ডায়ালাইসিস সেন্টার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement