১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নদীভাঙন রোধে প্রয়োজন টেকসই পদক্ষেপ

-

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। এখানে ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। নদীভাঙনও তেমনি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্লাবন ভূমির প্রায় ৫ ভাগ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। নদীতে যখন প্রচণ্ড স্রোত থাকে তখন এসব ঢেউ দুই পাড়ের ক্ষয় ঘটায়। ফলে নদী পাড়ের মাটি সাধারণত দুর্বল হয়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতি বছর বর্ষার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত নদীভাঙন চলতেই থাকে। সেখানে মাঝে মধ্যে সাময়িক প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করলেও স্থায়ী বা টেকসই হয় না। বসতভিটা, হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি স্থাপনা, ধর্মীয় স্থাপনা, চিকিৎসাকেন্দ্র সব কিছুই নদীতে চলে যাচ্ছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে কয়েক লাখ পরিবার।
ভাঙন সবচেয়ে বেশি হয় বর্ষাকালে। সাধারণত বন্যার ফলে। এ ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে নদীভাঙনের, যেমনÑ অতিরিক্তি বৃষ্টিপাত, নদী পাড়ের বৃক্ষ কর্তন, তীব্র স্রোত প্রভৃতি। ভূতাত্ত্বিক আকারের কারণেও ভাঙন হয়ে থাকে। ভাঙন নির্ভর করে নদী তীরের গঠন প্রকৃতির ওপর। তীরবর্তী প্রবাহের তীব্রতা, নদীর প্লানফর্ম এবং নদীতে পানি ও অবক্ষেপের সরবরাহ ইত্যাদির ওপর। যেমন- যমুনা নদীর প্রস্থ বেশি গভীরতার তুলনায়। যখন পানি উজান থকে সাগরের দিকে যেতে থাকে তখন অতিরিক্ত চাপে দুই পাড়ের কয়েক মিটার ভেঙে যায়।
বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে পড়েছে এক হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকা হচ্ছে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রবিধৌত অঞ্চল। পদ্মার তীব্র স্রোতে এটিকে বলা হয় বিশ্বের তীব্র ভাঙনপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ এলাকা হলোÑ বগুড়া, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাওয়া, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও ময়মনসিংহ। তবে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি নদীগুলোও বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) তথ্যমতে, ১৯৭৩-২০০৮ সাল পর্যন্ত ভোলার মূল ভূ-ভাগ থেকে ২৪০ বর্গকিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কোপেনহেগেনে জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (২০০৯) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনগুলোর একটিতে জানানো হয়, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় প্রায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে।
বর্তমানে প্রায় ১০০টি থানায় নদীভাঙন ও বন্যার দুর্ভোগ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতি বছর নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। আশপাশের গ্রামের মানুষের কাছে পাহাড়ি ঢল মানেই এক বিরাট আতঙ্কের নাম। সবসময় আশঙ্কায় থাকে কখন তাদের বসতবাড়ি, কৃষিজমি চলে যায় নদীতে। ভাঙনের অপেক্ষায় রযেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্থাপনা।
ঢাকার বস্তিগুলোর ওপর পরিচালিত একটি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, ছিন্নমূল পরিবারের অধিকাংশই এসেছে ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে। এসব বস্তিবাসীর অধিকাংশই আবার পদ্মা, মেঘনা নদীর ও এদের সম্মিলিত মোহনার আশপাশে অবস্থিত কয়েকটি থানা নিয়ে গঠিত সীমিত এলাকা থেকে এসেছে।
নদীভাঙনের ফলে স্থানচ্যুতির ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো পরিবারই পথে বসে। অনেক পরিবার তখন সব কিছু হারিয়ে বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়। নদীভাঙনে আশ্রয়হীন যেসব পরিবার বিভিন্ন বাঁধের ওপর অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছে, তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীভাঙনের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এবং বিপদাপন্ন লোকের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বেড়েছে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের জমি, বসতভিটা, ফসল, গবাদিসম্পদ, গাছপালা, গৃহসামগ্রী সব কিছুই নদীতে বিলীন যায়। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের ফলে গ্রামীণ কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। বসতভিটার সাথে তাদের কৃষিজমি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এক দিকে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি আয় কমে যায়, অন্য দিকে দেখা দেয় ওই অঞ্চলে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি। আবার নিচু জমিতে নদীর পানি প্রবেশ করে তা ফসলের অনুপযোগী করে দেয়। সিইজিআইএসের তথ্য মতে, প্রতি বছর ভাঙনে নদীতে চলে যায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখ খানেক পরিবার।
নদী রক্ষাবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে মূলত বন্যা ও বন্যার সাথে আসা বিপুল পলিমাটিকে এ ভাঙনের জন্য দায়ী করা হয়েছে, সেই সাথে তীব্র স্রোত রয়েছে নদী শাসনগত সমস্যা। বর্তমানে আমরা যেভাবে নদীভাঙন রোধ করতে চাই তা আধুনিক ও মানসম্মত পদ্ধতি নয়। ফলে এই নদী রক্ষা বাঁধগুলো স্থায়ী হয় না বা সামান্য বর্ষণে ভেসে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে নদীর দুই পাড়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা। প্রকৃত পরিকল্পনার অভাব রয়েছে নদী রক্ষা প্রকল্পগুলোতে। বিশেষ করে নদীভাঙন রোধে অধিকাংশ কাজগুলো করা হয় বর্ষার শুরুতে ফলে বাঁধটি কাঁচা অবস্থায় ভেঙে যায়। যখন মধ্য বর্ষায় ভেঙে যায় তখন বালুভর্তি বস্তা দিয়ে সাময়িক মেরামত করার চেষ্টা করা হয়Ñ কিন্তু অতি বৃষ্টি বা বন্যায় সে আসায় গুড়েবালি। এর ফলে বাঁধটি ভেঙে যায়, আর তার ফল হয় আরো ভয়াবহ।
নদীভাঙন সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান হবে না। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনামতো কার্যক্রম হাতে নিলে নদী পাড়ের মানুষের দুঃখ কিছুটা লাঘব হতে পারে। প্রথমত, নদীর নিকটবর্তী পরিবারগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রমের বিকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ নদীর পাড়ে স্থায়ী অবকাঠামো (সিমেন্টের ব্লক, কংক্রিট উপাদান দিয়ে একধরনের শিলা খণ্ড) গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে নদীর নাব্যতা যেন ঠিক থাকে সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে নদী তীরের ক্ষয়রোধ করতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আধুনিক প্রযুক্তির যোগ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল


আরো সংবাদ



premium cement