১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধামা বসিয়ে চাপা দেয়ার ক্যারিশমা

-

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এসি বিস্ফোরণে লাশের সারির ঘটনা তামাদির দিকে। মসজিদটাই যেখানে অবৈধ, সেখানে এসব মৃত্যু নিয়ে বেশি মাতামাতির কিছু নেইÑ এমন একটি যুক্তি ও মতামত আরোপের চেষ্টা বেশ স্পষ্ট। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডও বাসির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। সিনহা ঘটনার রেশের মধ্যেই হাতুড়িপেটায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের জান নিয়ে টানাটানির ঘটনাও বিচ্ছিন্ন।
ইউএনও একটি উপজেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। দুর্বৃত্তরা যখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার সাহস পায়, তখন ওই জনপদেরই কেবল নয়- রাষ্ট্রের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমাদের উপায় কী। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে দুর্বৃত্তরা উপজেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার সাহস পায়Ñ সেই প্রশ্ন এড়ানো যায় না। একজন ইউএনওকে কুপিয়ে মরণাপন্ন করে ফেলার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কর্মতৎপরতাকেও কিন্তু পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে। যখন একজন ইউএনও সরকারি বাসভবনে নিরাপদ না থাকলে রাষ্ট্রের সার্বিক চিত্রটা যেকোনো বিবেকবান মানুষের জন্যই ভীতিকর হয়ে ওঠে।
কেউ বলতে চান, হাতুড়ি যখন ভিন্নমতের শরীরে আঘাত করেছিল, তখন ব্যবস্থা নিলে তা ইউএনওর মাথা পর্যন্ত না-ও পৌঁছাতে পারত। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, লাইনের লিকেজ থেকেই গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বাইতুল সালাত জামে মসজিদটি। তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে সেই লিকেজ লাইন মেরামত করার কথা বলা হলে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। মসজিদ কমিটি জানিয়েছে, তারা টাকাটা জোগাড় করতে না পারায় সেটি আর মেরামত করা হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ ও তথ্যের আড়ালে আরো কতো জিজ্ঞাসা থেকে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রধানের ভাষ্যমতে, ‘মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে একটি গ্যাসের লাইন গেছে। সেই লাইন থেকে গ্যাস লিক হয়ে বদ্ধ মসজিদের ভেতরে জমা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডিজির বক্তব্য সত্য হলে প্রশ্ন ওঠে, মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে গ্যাসলাইন যায় কিভাবে? নিশ্চয় গ্যাসলাইন আগে গেছে, তার পর সেই লাইনের ওপর মসজিদ তৈরি হয়েছে? গ্যাসলাইনের ওপর মসজিদ তৈরি কারা করেছে? কারা এ মসজিদ ভবন তৈরির অনুমোদন দিয়েছেন? মসজিদ কমিটির দায়িত্বে যারা, স্থানীয় প্রশাসনÑ তারা কি জানতেন না মসজিদটি নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি বেআইনি কাজ করা হয়েছে?
কেবল গ্যাস নিঃসরণ বা অন্য কোনো কারণ সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে এ ঘটনার উপসংহারে পৌঁছা যায় না। কে না জানে, বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও গ্যাস অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে দরজা বন্ধ করে একা একা ঘুষ খান। এই ঘুষের ভাগ অনেক ওপর পর্যন্ত যায়।
ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার মতো টানা গত এক দশকের বেশি সময়ে লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, জালিয়াতিসহ নানা ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকদের জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। প্রায় সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালানো হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে। এর আগে বিশ্বজিৎ, অভিজিৎ, নুসরাত, তনু, মিতু, খাদিজা, মিন্নি, নয়ন বন্ড, একরাম হত্যাসহ বহু ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাম দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। ওই সব চেষ্টা কম-বেশি সফলও হয়েছে। তলানিতে চলে গেছে বহু ঘটনা। মানুষও ভুলে গেছে। কয়েক দিন আগে ভেজালে রাজি না হওয়ায় পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়ারকে পিটিয়ে আধমরা করার ঘটনা ধামাচাপা পড়তে সময় লাগেনি। করোনা মহামারীতে দেশ-দুনিয়া লণ্ডভণ্ডের মধ্যে ধারণা হয়েছিল অন্তত জীবন-মরণের এ সন্ধিক্ষণে অপরাধীরা কিছুটা হলেও হাত গুটিয়ে নেবে। মরণের ভয়ে বা পাপে-তাপে কিছুটা মানবিকতার তাড়না জাগবে। টান পড়বে অপকর্মে। ধারণা বাস্তব হয়নি।
চুরি, ছেচরামি, ঠকবাজি, কালোবাজারি কোনটাতে কমতি হয়নি। বরং আরো বেড়েছে। তাও বিচ্ছিন্ন নয়। একেবারে ধুমছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে। করোনা চিকিৎসায় এমনকি পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বাণিজ্যেও বুক কাঁপেনি ঠকবাজদের। সুস্থ হওয়া করোনা রোগীর প্লাজমা নিয়ে কুব্যবসাও বাদ যায়নি। চার দিকে উল্টা যত ক্রিয়াকর্ম। মহামারী বরং অনেককে আরো বেপরোয়া করছে। মওকা করে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা হাতানোর। পুকুর চুরির বদলে বেড়েছে সাগর চুরি। এ দুর্যোগের মাঝেও বোরোর বাম্পার ফলন ফলিয়েছে কারা? কৃষকরা। তাদের কল্যাণে কারো মন গলেছে? ধান-চালের বাজারে নতুন মজুদদার যোগ হয়েছে। তাদের একেকটা প্রতারণাবিশারদ। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ মৌসুমি ফলের বাজারেও কুকর্মের শিরোমণিদের দাপট। সাথে আদর কদর। কেমিক্যালের ছড়াছড়ি। এমন মহামারীও দুষ্টুচক্রের জন্য সুসংবাদ। প্রতিদিন মানুষ মরছে, বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অব্যাহত চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে, শিশু অপহরণ হচ্ছে, নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কয়টা ঘটনা জনসমক্ষে প্রচারিত হয়? আর বিচারই বা কয়টার হচ্ছে?
এ কেমন ব্যবস্থা? কেমন মানসিকতা? কী নিদারুণ রসিকতা? সব মিলিয়ে অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, কোনো ঘটনাই আর দেশে ঘটনা নয়। দুর্ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটছেও না, যা কখনো ঘটেনি বাংলাদেশে। একদম নতুন তেমন ঘটনা নেই, যা ঘটছে প্রায় সবই বাসি ঘটনার চেয়ে একটু কম বা বেশি। শেষ পর্যন্ত ঘটনা কি এখানেই বা এমনই থাকবে? নতুন কিছু ঘটে বসে যদি? কোনো ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার, রিমান্ড, দল থেকে বহিষ্কার ফয়সালা নয়। প্রদীপদের গুলিতে সিনহা হত্যা, হাতুড়ি বাহিনীতে ওয়াহিদা-বদরুলদের পঙ্গু করে দেয়ার ঘটনার ওপর ধামা বসিয়ে চাপা দেয়ার ক্যারিশমা দেখানো যায়। কথার ছল বা মুখপাণ্ডিত্যের ঘটনাকে পানসে করা দেয়া যায়। একটি ঘটনা এসে আরেকটি ঘটনাকে সরিয়ে দেয়। এই মেগাসিরিয়াল লেগেই আছে। কোনো কিছুরই মীমাংসা হয় না, কোনো ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয় না। মসজিদে বিস্ফোরণের আরো বহু আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনাকেও বলা হয়েছিল, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
আপাত অর্থে, সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সাবেক মেজর হত্যা, ইউএনওকে হাতুড়িপেটা ছাড়াও মিন্নি, নুসরাত, খাদিজা, ত্বকী, ছেলেধরা সন্দেহে মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বানানো, খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, অমুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তুলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেয়া, ক্যাসিনো, বালিশ-পর্দা কাণ্ড, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্টে লোহার জায়গায় বাঁশ দেয়া, বাসের ভেতর গণধর্ষণ, বাস থেকে যাত্রীকে ফেলে তার বুকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়া, সবই একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মশা মারা শিখতে, পুকুর কাটা শিখতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস যাওয়াও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নকল পিপিই, মাস্কের ব্যবসা হাতানো, সাহেদ-সাবরিনাদের করোনা টেস্ট জালিয়াতিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনার এই মেগাসিরিয়াল আর কত? এমন বিচ্ছিন্নতায় আর কত অবিচ্ছিন্ন হওয়া? মোটকথা সব কিছুকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার রোগ থেকে বুঝি মুক্তি মিলবে কবে? সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে আসল ঘটনা জানার সৌভাগ্য কবে হবে মানুষের? কবে আসবে নিরবচ্ছিন্নতা? নাকি বিচ্ছিন্নতার আড়ালে নিরবচ্ছিন্ন অঘটনের জালে প্যাঁচিয়ে নেয়ার কোনো অপখেলা চলছে? হ
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের স্থায়ী জামিন হয়নি, বেড়েছে মেয়াদ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ড. ইউনূস কুমিল্লা জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রমিজ খানের ইন্তেকাল দরিদ্রতম দেশগুলোর উন্নয়ন ঐতিহাসিক মাত্রায় বিপরীতমুখী : বিশ্ব ব্যাংক ঢাকাসহ ৩ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস ময়মনসিংহে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ২৫ দেশকে অপশাসন মুক্ত করতে আলেমদের ভূমিকা রাখতে হবে : ড. রেজাউল করিম ইরানের হামলার জবাব দেয়া হবে : ইসরাইলের সেনা প্রধান সাভারে দর্জির দোকানে এসি বিস্ফোরণ, বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৩ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে জামিন চাইবেন ড. ইউনূস ইরান-ইসরাইলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন মোড়, এখন যা হবে

সকল