১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নৌবাহিনীর দুঃসাহসী এক সিন্দাবাদ

-

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও আমাদের কাছে গত ৪ আগস্ট ছিল একটি শোকের ও বিষাদের দিন, স্বজন হারানোর দিন। সেদিন আমাদের দেশের নৌবাহিনী পরিবার হারিয়েছে দুঃসাহসী, মেধাবী, চৌকস এক তরুণ অফিসার। যশোরবাসী হারিয়েছি এক গর্বিত সন্তানকে। আজিজুল হাকিম তূর্য (২৭) আমাদের বংশের গর্ব। আত্মীয়স্বজন, গ্রাম-এলাকাবাসীর কাছে ছিল অতি প্রিয় একটি নাম, পরিচিত মুখ। যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের ও মা আনোয়ারা খাতুনের একমাত্র পুত্রসন্তান। ১৯৯৩ সালের ১৯ নভেম্বর তার জন্ম। স্থানীয় মুন্সী মেহেরুল্লা ক্যাডেট স্কুল হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা লাভের পর বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় এবং সেখান থেকে ২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ প্লাস পেয়ে পাসের পর যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হয়। বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ২০১৩ সালে এ গ্রেড লাভ করে। তারা দুই ভাইবোন। সাত বছর আগে তারা মাকে হারিয়েছে।
২০১৫-১৭ সালে তূর্য বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির (বিএমএ) ৭৫তম তিন বছর মেয়াদি কোর্সে প্রশিক্ষণ শেষে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করে। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত, শ্রীলঙ্কা ও লেবানন প্রভৃতি দেশ সফর করেছে। আগামী ডিসেম্বর মাসেই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে পদোন্নতি ও জানুয়ারি মাসে চীনে যাওয়ার কথা ছিল।
৪ আগস্ট হঠাৎ আমার চাচা আবু তাহেরের বাড়ি হতে হইচই আর কান্নার রোল শুনতে পাই। দ্রুত ছুটে যাই। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সিও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তানভীর তার বাবাকে জানান ‘আজিজ কি আপনার একমাত্র ছেলে? সে অসুস্থ। তার অফিসিয়াল নাম আজিজুল হাকিম। ‘আজিজ’ নামেই অফিস ও জাহাজের সহকর্মীদের কাছে পরিচিত। আন্টিকে নিয়ে চলে আসুন।’ চাচা আবু তাহের তার নোট বুক (মোবাইল নম্বর লেখা) আমাকে দিয়ে বললেন এই নম্বরে আপনি কমান্ডারের সাথে কথা বলুন। তিনি আমাকে একই কথা জানান, আপনাদের কারো আসতেই হবে। তখনই আমি ধরে নিলাম তূর্য আর নেই।
ওই দিন রাতেই যশোর থেকে তূর্যের ভগ্নিপতি অ্যাডভোকেট পারভেজ বিমানযোগে চট্টগ্রামে পৌঁছে পরিবারের পক্ষে লাশটি গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম থেকে রাতেই লাশবহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ও আরেকটি মাইক্রোবাসে নৌবাহিনীর সদস্যরা ৫ আগস্ট লাশটি বাড়িতে নিয়ে আসেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে খাটিয়াটি নামানোর পর সেখানে সৃষ্টি হয় মর্মান্তিক এক বেদনাবিধুর ও হৃদয়বিদারক পরিবেশ। বুক ফাটা কান্না। সারা গ্রামজুড়ে তখন কান্নার রোল, আহাজারি। তার খেলার সাথী, বন্ধুরা একে একে আছড়ে পড়তে থাকে রাস্তার ওপর। দিতে থাকে গড়াগড়ি। ফলে আকাশ বাতাস হয়ে ওঠে ভারী। আবু তাহের তার একমাত্র মা-হারা সন্তানকে হারিয়ে পাগলের মতো বুক চাপড়ে বারবার বলতে থাকেন, এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব? এই দৃশ্য দেখার পর উপস্থিত কেউ চোখের পানি সংবরণ করতে পারেনি। তূর্যকে হারানোর বেদনায় মনে হয়েছে তার অভাবে সারা গ্রামের গাছপালা, পশুপাখিও যেন কাঁদছে। সবাই স্বজন হারানোর দুঃখে হয়েছেন ব্যথিত।
পরপর দু’দিন ৪ ও ৫ আগস্ট গ্রামভর শুধু চলে কান্নার আওয়াজ। ৪ আগস্ট সকালে প্রথম এই দুঃসংবাদটি বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকেই সৃষ্টি হয় এই শোকাহত পরিবেশ। এমন দৃশ্য আমি এই ৭৮ বছর বয়সে কখনো দেখিনি। তূর্য ছিল যেমন তার পরিবারে, তেমনি আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীদের কাছে চোখের মণি। গ্রামের একটি সুসন্তান, ভালো ছেলে হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল ব্যাপক।
৫ আগস্ট বাদ জোহর চুড়ামনকাটি হাইস্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। খুলনা নৌবাহিনীর একদল সদস্য ও এলাকার সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেন। পারিবারিক গোরস্থানে নৌবাহিনী গার্ড অব অনার শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় তাকে।
৭ আগস্ট শুক্রবার গ্রামের মসজিদে তূর্যের রূহের মাগফিরাত কামনায় এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। একই দিনে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও সব মসজিদেও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। ওই মাহফিলে নৌবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন লে. ইমরান। তিনি মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের নৌবাহিনীর ৮০ জন অফিসারের মধ্যে তূর্য ছিলেন খুবই মেধাবী অফিসার। আগামী ৫০ বছরেও এমন সুদক্ষ অফিসার আর জন্মাবে না নৌবাহিনীতে। তার এই অকাল মৃত্যুতে শুধু নৌবাহিনী একজন অফিসারকে হারায়নি। দেশ ও জাতি হারিয়েছে এক অমূল্য সম্পদ। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সরকারের ব্যয় করতে হয়েছে অনেক অর্থ।
তূর্যের দুঃসাহসিকতার এক চমকপ্রদ কাহিনী নৌবাহিনীর কাছে একটি ইতিহাস হয়ে আছে। তাদের যুদ্ধজাহাজ ‘শাহজালাল’ চট্টগ্রাম থেকে ৭ শ’ নটিক্যাল গভীর সমুদ্রে অবস্থান করছিল। জাহাজে কর্মরত নৌবাহিনী সদস্যদের হঠাৎ বমি দেখা দেয়। এর ফলে অনেকেই হয়ে পড়েন খুবই অসুস্থ। ওই সঙ্কটকালে তূর্যের সাহসী নেতৃত্বে জাহাজটি চালনা করে নৌঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনা হয়। নৌবাহিনীতে বীরোচিত ঘটনাটির খবর ছড়িয়ে পড়ে। বাবা আবু তাহের বেশ কয়েকবার চট্টগ্রামে মেরিন একাডেমি আয়োজিত অভিভাবক দিবসে যোগদান করেছেন। নৌবাহিনী তূর্যের সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য সম্মাননা প্রদান করেছে। এসবই এখন সবার কাছে দুঃসহ বেদনা আর স্মৃতি। তূর্যের সাহসিকতা, কর্মনিষ্ঠা ও বিন¤্র আচরণের জন্য সে তার জাহাজের কমান্ডার তানভীরের খুবই সুনজরে পড়ে ছিল। এ জন্য তাকে তিনি খুবই ¯েœহ করতেন। এক সুদর্শন চেহারার অধিকারী সে ছিল খুবই ভদ্র বিনয়ী ও অমায়িক মার্জিত।
গ্রামের ছোট বড় কেউ কোনো দিন পারবে না বলতে সে কষ্ট দুঃখ দিয়েছে কিংবা, কারো সাথে করেছে মারামারি, ঝগড়া। এ জন্য লাজুক স্বভাবের এই ছেলেটির ছিল অগণিত বন্ধু। খুবই বন্ধুপ্রিয়, বন্ধু-পাগল তূর্য ছুটিতে বাড়িতে আসার পর ক’দিন ধরে চলত বন্ধুমেলা। প্রতিদিন বাড়িতে বসত তাদের নিয়ে জমজমাট আসর। খাওয়া-দাওয়া, চা-নাস্তা আনন্দ কলরব। প্রতিবারই বনভোজনের আয়োজন করা হতো।
এবার ঈদেও টাকা পাঠিয়েছে তার বাবার কাছে কোরবানির জন্য। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, ঈদের ঠিক তিন দিন পরই সে লাশ হয়ে ফেরে বাড়িতে। অক্টোবর মাসেই তার এনগেজমেন্ট হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে আশা পূরণ হলো না পরিবারের।
তূর্যের বিচরণ ছিল সাগরের মধ্যে যুদ্ধজাহাজে। হঠাৎ এক সামুদ্রিক ঝড় এসে ভেঙে দিয়ে গেছে যেন যুদ্ধজাহাজ ‘শাহজালালের’ একটি মাস্তুল। দপ করে নিভে গেছে আমাদের বংশের গৌরব, এক উজ্জ্বল বাতি। তাহেরের পরিবারের সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে চিরতরে। নেমে এসেছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার।
হে মাবুদ, হে দয়াময়, হে রহমানুর রহিম, আমাদের সবাইকে এই শোক সইবার ক্ষমতা দাও। এই প্রার্থনা করি তোমারই কাছে। হ
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement