২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রচ্ছন্ন যৌতুক প্রথা

-

‘যৌতুক দিবেন না, যৌতুক নিবেন না।’ মুখে মুখে বুলিটি সবাই আওড়ান। অথচ বাংলাদেশে যৌতুক দেয়া এবং নেয়ার পরিসংখ্যান ১০০ শতাংশ। কিন্তু কেউই আজকাল সেটি যৌতুক বলে গ্রহণ কিংবা প্রদান করেন না।
হিন্দু আইন অনুযায়ী মেয়েরা মা-বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। তাই হিন্দু ধর্মে বিয়ের সময় মেয়ের সাথে উপঢৌকনস্বরূপ সম্পত্তি প্রদান রীতিমতো বৈধ। মুসলিম সমাজেও পূর্বপুরুষদের এ হীন প্রথা প্রচ্ছন্নভাবে আত্তীকরণ করা হয়েছে।
যৌতুকের বিরুদ্ধে সেøাগান দেয়, যৌতুককে ঘৃণা করে। অথচ মেয়ের বিয়ের সময় সাথে এটা সেটা দিয়ে থাকে। আবার ছেলের বিয়ের সময় কনেপক্ষের কাছ থেকে অনুরূপ কামনা করে। কখনো ভাবে না যে এটিই যৌতুকের আপডেট ভার্সন। এ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমানের প্রায় শতভাগ। ইসলামে কনেপক্ষ থেকে উপঢৌকনস্বরূপ কোনো কিছু গ্রহণের বিধান নেই। তবু যুগ যুগ ধরে শুধু রেওয়াজ হিসেবে এই কুপ্রথা প্রচলিত রয়েছে। কোনো বেআইনি কাজ যখন সবাই করে তখন সেটা প্রথায় রূপান্তরিত হয়। তখন সেটাকে কেউ অপরাধ মনে করে না। সমাজে জেঁকে বসা এমন প্রথার মূলোৎপাটন রীতিমতো দুঃসাধ্য। তবে অসম্ভব নয়। কেননা ভারতে হিন্দু সমাজে শত শত বছর সতীদাহ প্রথার মতো মানবতাবিরোধী প্রথা বিদ্যমান ছিল। কৌলীন্য, বিধবাবিবাহবিরোধী, যৌতুক প্রভৃতি প্রথাও বাঙালি সমাজকে ক্যান্সারের মতো যুগ যুগ ধরে আক্রান্ত করে এসেছে।
যৌতুক বাঙালি সমাজে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রথা।
কুসংস্কার ও অনৈতিক প্রথাকে সমাজে টিকিয়ে রাখতে সবসময় খোঁড়া যুক্তির আশ্রয় নেয়া হয়। নীরবতা, নিমরাজি কিংবা নাম পরিবর্তন করে চালিয়ে নেয়া হয়। (উদাহরণস্বরূপ, সুদ খাওয়া হারাম কিন্তু মুনাফার নামে আমরা অবলীলায় খাচ্ছি। বিয়ের সময় মেয়েদের সাথে কোনো উপঢৌকন প্রদান যৌতুক প্রথার সমকালীন সংস্করণ। আজকাল আমরা সভ্য হয়েছি। তাই এটিকে যৌতুক বলে গ্রহণ করতে নারাজ। অথচ এটি গ্রহণের লোভও সামলাতে পাছি না। তাই ছলাকলার আশ্রয় নিই। কখনো বরপক্ষের উক্তি, ‘আমরা শুধু মেয়েকে চাই। অন্য কিছু নয়। আপনাদের যা ইচ্ছে হয় মেয়ের সাথে দিবেন। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।’ অনেকে আবার চতুরতার সাথে বলেন, ‘আমরা শুধু মেয়েকে চাই। তবে যেভাবে চলছে সমাজে যেমন একটা মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, সোফাসেট এসব কী আর বলতে হয়। আমরা এসব খুঁজেটুজে ছোটলোক হতে চাই না।’
কেউ আবার খুঁজে আনাকে যৌতুক মনে করলেও না খুঁজে আনাকে মনে করেন না। তাদের উক্তি, ‘আমরা তো কিছু চাচ্ছি না। তারা খুশি হয়ে দিলে কেন গ্রহণ করব না।’
আজকাল কিছু কর্মকর্তা ও নেতা চাকরি কিংবা কোনো সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করেন না। চা নাশতার পয়সা গ্রহণ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে এর পরিমাণ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঈদ-সেলামির নামে কোটি টাকা দাবির গল্প আমরা জানি। বর্তমানকালে তেমনিভাবে যৌতুক প্রদান এবং গ্রহণ হয়ে থাকে উপহারের নামে। ‘আমার মেয়ে অপরের বাড়িতে গিয়ে কার জিনিসে হাত দিবে।’ সেই ছুতায় কনেপক্ষ মেয়ের সাথে উপহারের নামে যৌতুক দেয়। একবারও ভেবে দেখেন না যে বরের বাড়ি অপরের বাড়ি নয়। এটা মেয়ের নিজের বাড়ি। সত্যিকারার্থে এই ধ্যানধারণাটা মানসিক সঙ্কীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ।
রোগ শনাক্ত না হলে যেমন নিরাময় করা কঠিন। অধিকার কি না জানলে যেমন অধিকার সচেতন হওয়া যায় না। নিজেকে না জানলে যেমন জগৎ জানা হয়ে ওঠে না, তেমনি কোনটি অপরাধ, কোনটি কুসংস্কার সেটি না জানলে সংস্কারমুক্ত হওয়া দুরুহ। গভীর ঘুমে নিমগ্ন ব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলা সহজ। কিন্তু যে বা যারা জেগে ঘুমের ভান করেন, তাদের জাগিয়ে তোলা বড্ড কঠিন। প্রচ্ছন্ন এ যৌতুকের বিষয়ে আমাদের সমাজ জেগে জেগে ঘুমুচ্ছে। প্রচ্ছন্ন এই কুসংস্কার যৌতুক নির্মূলে আজ আমাদের এক যুগপুরুষের বড় প্রয়োজন। ‘যুগ জামানা পাল্টে দিতে চাই না অনেকজন।
এক মানুষই আনতে পারে জাতির জাগরণ।’ হ
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরো সংবাদ



premium cement