১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবনের জন্যই প্রকৃতি

-

প্রকৃতি বলতে আমাদের সামনে ভেসে উঠে সবুজে ঘেরা অরণ্য। বস্তুত যাকে বলা হয় বন। একটি বনের মাঝে রয়েছে অসংখ্য জীববৈচিত্র্য। বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির অবাধ চলাফেরা, পাখির কিচির মিচির, বাইরের সবুজে আবৃত মনোরম এক পরিবেশ যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রায় রাখে অসামান্য অবদান। সবার চোখে বন কেবলই এক মনোরম পরিবেশ হলেও বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বিশাল এক সরবরাহ আসে এসব বন থেকে। এক আমাজন থেকে আসে পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ। যার জন্য আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। কিন্তু আমরা মানব সমাজ বারবার উঠে-পড়ে লেগেছি আমাজনকে ধ্বংস করতে। একবার দু’বার নয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আমাজন বনে ৭২ হাজার ৮০০টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার ১৩৬ বার। ২০১৩ সালে ব্রাজিলে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে (৩৫,৫৬৭ বার), ২০১৯ সালের চার মাস বাকি থাকতে এর চেয়ে বেশি আগুন লেগেছে। ফলে ব্রাজিলে অবস্থিত ৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার আমাজন বন হুমকির সম্মুখীন হয়। তার প্রমাণ মেলে আমাজন অববাহিকায় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাসের মধ্যে বন উজাড়ের হার ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া।
বিজ্ঞানীদের এক দল বলেছেন, শুষ্ক মৌসুমে আমাজনের জঙ্গলের দাবানল একটি প্রচলিত ঘটনা। এ দাবানল তৈরি হতে পারে প্রাকৃতিক কারণে যেমন বাজ পড়লে। এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজের গবেষক ও জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য অপো করেন। এ সময় খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে। আবার কিছু কৃষক ও কাঠুরিয়া ফসল উৎপাদনের জন্য জমি পরিষ্কার করার কারণে জঙ্গলে আগুন দিয়ে থাকে।
শুধু এক আমাজন নয়, আগুন লেগে দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। যে দাবানলে পুড়েছে কোয়ালা, ক্যাঙারু, কাঠবিড়ালিসহ হাজার হাজার পাখি। চার দিকে আগুনের লেলিহান শিখা। মানুষের অসহায় চোখে আতঙ্ক খেলা করেছে। কোটি কোটি জীবন্ত জীবজন্তুর আর্তনাদ আগুনের লেলিহান শিখা গিলে খেয়েছে। পরিস্থিতি সামলে নিতে নিতে আবার নতুন করে অগ্নিপাতের সৃষ্টি হচ্ছে আরেক অঞ্চলে। দাবানলের ভয়ঙ্কর শিখা নির্দিষ্ট এলাকায় এমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল যে এর আশপাশে এমনকি আকাশসীমার ওপর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এ কারণে বিমান, হেলিকপ্টার এর ওপর দিয়ে উড়াল দিতে অমতা প্রকাশ করেছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে; যার ফলে পরিস্থিতি দিন দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। আইপিসি জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের সাম্প্রতিক একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এসব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সর্বশেষে প্রতিবেদনে জানা যায়, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বরফে আচ্ছাদিত সমুদ্র অঞ্চলের ওপর এর প্রভাব কী হতে পারে; খুব সংেেপ বলতে গেলে সাগর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে দ্রুতহারে এবং এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণিজগতের ওপর। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সাগরের ভবিষ্যৎ এখনো আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু তার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে এখনকার চেয়ে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমপে ৪৫ ভাগ কমাতে হবে।
২০২০ সালের এ সময় দাঁড়িয়ে আমরা যখন প্রকৃতি সংরণ নিয়ে আলোচনা করছি হয়তো বাংলাদেশের কোনো একটি অসাধু চক্র ধ্বংস করছে হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি। আমরা বুঝে না বুঝে, হেলায় ফেলায় যে হারে বন ধ্বংস করছি, তার ফলে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। নিজেরাই নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি খারাপ সময়ের দিকে। বন ধ্বংস করতে করতে আমরা যে কখন নিজেদের ধ্বংস করে ফেলছি, তা নিজেদেরই অজানা রয়ে গেছে।
একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। সেখানে আমাদের দেশে আছে ১৭ শতাংশ। কোনোভাবে বনভূমি বাড়ানো যাচ্ছে না, বরং দিন দিন কমছে। মানুষ হানা দিচ্ছে প্রকৃতির দুর্গম এলাকায়। যে সুন্দরবন ছিল সুরতি সেখানেও এখন মানুষের বেশি ব্যবহারে তিগ্রস্ত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বনভূমি। কিন্তু মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় কক্সবাজারের বিশাল বনভূমির তি হয়েছে। এর সাথে বনদস্যুরা তো আছেই, যারা চুরি করে গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে। সরকারিভাবে এ দস্যুদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, জেল ও পেনাল্টি হিসেবে বিশাল অঙ্কের অর্থ। কিন্তু তার পরও কমানো যাচ্ছে না বন উজাড়।
সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশের বনাঞ্চলের সংখ্যা ১৭ শতাংশ হলেও জাতিসঙ্ঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা গত ২০১৮ সালের ৯ জুলাই এক প্রতিবেদনে (দ্যা টেস্ট অব গ্লোবাল ফরেস্ট ২০১৮) বলেছে বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। সিএফও ও ডব্লিউআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। ২০১০ সালে দেশের মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ ছিল এ এলাকায়। ৭ বছরে কমে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনে ২০১৮ সালে ছয় মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে নষ্ট হয়েছে প্রায় ৫ হাজার একর বনভূমি। কক্সবাজারে আরেক উপজেলা মহেশখালীর সংরতি বনের ২০০ একর জায়গা মে মাসে অধিগ্রহণ করা হয়েছে অপরিশোধিত তেলের ডিপো ও পাইপ লাইন স্থাপনে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বনের জায়গায় গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ অবস্থায় দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি কমবেÑ এটিই স্বাভাবিক। এফএওর বিশ্ব প্রতিবেদন ২০১১ মতে, বাংলাদেশের বনভূমি মোট ভূমির ১১ শতাংশ।
বৈশিষ্ট্যগতভাবে বাংলাদেশের বনগুলো কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছেÑ যেমন এর মধ্যে রয়েছে চিরহরিৎ বন, ক্রান্তীয় প্রায় চিরহরিৎ বন, ক্রান্তীয় পর্নমোচী বন, মিঠা পানির জলাভূমি বন, প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বন ও সৃজিত বন। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বা সুন্দরবনের ৬৫ শতাংশ আমাদের দেশে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সম্পদের আধার এ বন। হাজার হাজার পশুপাখি, প্রাণী এমনকি মানুষও বেঁচে থাকায় প্রত্য ও পরোভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন সিডর, আইলা, আমফানের মতো প্রলয়ঙ্করী সাইকোনের সময় সুন্দরবন বাংলাদেশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখের কথা হলো এ বনের যথাযথ সংরণ হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা দিন দিন কমছে। সাথে কমছে হরিণ, কুমির, বিভিন্ন পাখি, জলজ ও স্থলজ প্রাণীসহ বিপুল পরিমাণ বৃক্ষ।
প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত আহরণে প্রকৃতিতে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে বদলে হচ্ছে জলবায়ু। নদীর পানির নাব্যতা কমে যাচ্ছে। ভূমিধস, নদীভাঙন, অতি বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। গাছপালা কেটে, নদী ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে বড় বড় হাইরাইজড বিল্ডিং। ভূগর্ভের পানি অতিরিক্ত উত্তোলনে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফলে মরুকরণ প্রক্রিয়া হচ্ছে দ্রুতগতিতে। স্বাদু পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। উচ্চ ঘনত্বের লবণাক্ত পানি দখল করছে মিঠা পানির নেমে যাওয়া স্তরগুলোতে। প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার থেমে থাকছে না তবুও। গরমে সবাই হাঁসফাঁস করি এর জন্য দায়ী নিজেরাই। দায়ী সভ্য মানব সমাজ।
প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য, এর সংরণে এখন জাতিসঙ্ঘসহ অনেক সংস্থা বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। মরুকরণ প্রক্রিয়া রোধে নানাবিধ পদপে নেয়া হয়েছে। ওজোন স্তরের তি হ্রাসে করা হচ্ছে অনেক কিছু। এই করোনাকালে অ্যান্টার্কটিকের ওপরের ওজোন স্তরের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে হবে। পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণ সাধন করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। অন্যকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পরিবেশ রায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই।
মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির ওপর রাজত্ব করতে চেয়েছে। এ যেন মানবকুলের পৈশাচিক এক নেশা। যে খেলায় সব থেকে বড় ক্ষতি মানবকুলেরই হয়। তার পরও মানুষ সেই কুৎসিত খেলায় মেতে ওঠে। মানবকুল ভুলে যায়, প্রকৃতির প্রতিটি বিষয়ের সাথে তাদের জীবনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অবাধে পশু শিকার, মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা, নির্বিচারে গাছ কাটা, জলাশয় ভরাট করে বসবাসের ঘরবাড়ি নির্মাণ, বনের গাছ কাটা ও বনের জমি দখল এসব যেন মানুষের অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। ফলে প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিবিধি হারিয়ে ফেলছে। আমরা ভুলে যাই যে, ডাইনোসরের মতো শক্তিশালী প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির বিরূপ পরিবর্তনে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাতে হলেও প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। প্রকৃতির ওপর রাজত্ব নয়, বরং প্রকৃতির সাথে মানিয়ে চলতে হবে। তা না হলে টিকে থাকবে তেলাপোকার মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী আর ডাইনোসরের মতো পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে মানব জাতি। পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, কবি কাজী নজরুল বিশ^বিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement