২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের প্রয়োজন বিবেকবান মানুষ

-

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের মধ্যে একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং সে সমাজেই বেড়ে ওঠে। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়া মানুষকে সমাজের উপযোগী আচরণের জন্য প্রস্তুত করে থাকে। এ প্রক্রিয়াগুলোর প্রয়োগ যদি হয় সুষ্ঠু ও কার্যকর, তার মাধ্যমে সমাজ উপকার লাভ করে। এর ফলে সামাজিক উন্নতি যেমন হয়, তেমনিভাবে সারা দেশও উপকৃত হয়। অন্য দিকে এ প্রক্রিয়াগুলোর কোনো একটি যদি ব্যর্থ হয় কিংবা তার প্রয়োগ হয় অপরিপক্ব, তবে তার ফলাফলও হবে বিপরীতধর্মী। মানুষের বেড়ে ওঠার এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। বলা যায়, প্রধান ও একই সাথে জটিলতম প্রক্রিয়া হলো শিক্ষা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সমাজের জন্য উপযোগী করে তোলে। শিক্ষার প্রকারভেদ বিভিন্ন রকম হতে পারে। ব্যক্তিভেদে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তারও তারতম্য রয়েছে। আবার শিক্ষা একটি নিরন্তর ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশুর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়, তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা শিক্ষা পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই সর্বজনস্বীকৃত। নিঃসন্দেহে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যক্তির যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিরূপণের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি, তবে এটিই শেষ কথা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের যে শিক্ষা রয়েছে, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তার প্রভাব সীমাহীন। এমনকি অনেক সময় এ শিক্ষার তাৎপর্য ও ফলাফল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেও ছাপিয়ে যায়। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার।
গত কয়েক বছরের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দেশে অপরাধ বাড়ছে, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। গত কয়েক বছরে খুন, অপহরণ, ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনিভাবে আর্থিক কেলেঙ্কারি, অসততা, দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনাও বাড়ছে। একটি সমাজের মানুষের অপরাধে যুক্ত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে সর্বজনস্বীকৃত অনেক বড় কারণের মধ্যে যথাযথ শিক্ষার অভাব অন্যতম। কিন্তু এই ‘যথাযথ শিক্ষা’ বলতে অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বুঝে থাকেন। মূলত এখানেই সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও সমাধানের মাঝে একটি বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়, যার ফলে সর্বদা একটি অন্ধকার চক্রেই আবর্তিত হচ্ছে সমাজ। আমাদের সমাজের যারা অপরাধের সাথে জড়িত, তাদের সবাই কি অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত? কিংবা তাদের অপরাধের মূল কারণ কি পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব? ব্যাপারটি মোটেও এমন নয়। বড় বড় প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির যে তথ্য পাওয়া যায়, তার সবই উচ্চ শিক্ষাধারী ব্যক্তিদের হাত ধরে। সমাজের একেবারে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিরা যে অপরাধ করছে না, তা নয়। তবে উচ্চশিক্ষিত সমাজেরও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার হার চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সমাজের স্বাভাবিক সূত্র মতে এটি হওয়ার কথা নয় এবং কেন হচ্ছে, সেটি আমাদের বোঝা দরকার। এ করোনার সময়েও আমরা দেখছি কিভাবে একদল সুযোগসন্ধানী চক্র মানুষের সাথে প্রতারণা করে মুনাফা লাভ করছে। অথচ তাদের প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, সবারই রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি। এ থেকেই আমাদের বোঝা উচিত, অপরাধপ্রবণতার কারণ শিক্ষার অভাব নয় বরং নৈতিক শিক্ষার অভাব। কেননা এসব ব্যক্তির সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব ধাপ পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু ‘যথাযথ শিক্ষা’র অভাবই তাদের এই পথে এনেছে।
আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার বেড়েছে বহুগুণে। আগে যেখানে দশ গ্রাম মিলে একটিমাত্র স্কুল বা মক্তব ছিল, সেখানে এখন একই গ্রামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ রয়েছে। গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় বা
শহরজুড়ে স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে। এর সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কলেজের সংখ্যাও। গত কয়েক দশকে তাই আগের চেয়ে শিক্ষার হারও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। আবার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে বছরখানিক আগে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাধিক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। এর পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজ, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসহ দেশে উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিষ্ঠান হয়েছে অগণিত। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষাক্রম শেষ করে বেরিয়েও আসছে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। ফলে দেশে প্রতি বছর গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বাড়ছে সমানতালে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ পেরোনো এসব গ্র্যাজুয়েটের হাত ধরেই শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, বাণিজ্য, গবেষণায় দেশ এগিয়ে যাবেÑ এমনটিই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সমাজের অপরাধপ্রবণতার যে চিত্র আমাদের চোখে পড়ে, তা থেকে একটি প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক। এসব উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট কি সত্যিকার অর্থেই মানুষ হতে পারছে? নাকি এই শিক্ষা শুধু তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতাকেই সমৃদ্ধ করছে? যে মানবিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশ ও সমাজের উপকৃত হওয়ার কথা, অসংখ্য গ্র্যাজুয়েট তৈরির পরও কিছু পথভ্রষ্ট ব্যক্তি সে পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের অগ্রযাত্রার পথে শিক্ষিত সমাজ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি এমন ব্যক্তিরাও অবদান রাখছেন। দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পরও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কেন বাড়ছে না, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয়তা না বুঝেই মানুষ উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে। মূলত তাদের এই আগ্রহ শিক্ষা অর্জনের নয়, একটি সার্টিফিকেট বা ডিগ্রি অর্জনের। ফলে প্রকৃত শিক্ষা লাভের প্রতি তাদের মনোযোগ নেই এবং সে শিক্ষা তারা অর্জনও করতে পারছে না। অনেক পরিবারেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। এর ফলে একজন মানুষের জীবনে নৈতিক শিক্ষার যে অপরিহার্যতা রয়েছে শিক্ষার্থীরা সেটি অনুধাবন করতে পারে না। পরে এই শিক্ষার্থীরা যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন নৈতিক শিক্ষার এই অভাবই তাদের অপরাধপ্রবণ করে তোলে।
তাই সমাজের এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের আগে পরিবার ও সমাজ থেকেই একটি শিশুর শিক্ষাকাল শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু ডিগ্রি অর্জনই যে মূল কথা নয়, সেটি একজন শিক্ষার্থীকে বোঝাতে হবে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের সব ধরনের সংশয় দূর করতে হবে। একটি আলোকিত সমাজ কিংবা জাতি গঠনের জন্য উচ্চশিক্ষিত মানুষের যেমন প্রয়োজন, তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন বিবেকবান মানুষের। আমাদের সময় এসেছে সে দিকেই মনোযোগ দেয়ার। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ishrakf1971@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement