২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রহিমার চাওয়া-পাওয়ায় এত বাধা কেন?

-

বস্তির টিনশেড ভাড়া বাসা যেন রহিমার জন্য স্বপ্নবিলাস। বিদ্যুতের বাতি, সাপ্লাইয়ের পানি, নাগরিক জীবনের অধিকার কিছুই প্রয়োজন নেই তার। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে সুখের পরিবার। প্রত্যাশার চেয়েও যেন অনেক বেশি পাওয়া। স্বামী রূপবান সেখ একজন রিকশাচালক। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে রিকশা কিনে দিয়েছে। সপ্তাহে ২৫০ টাকা কিস্তি পরিশোধে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। সে কারণে ১২ বছর বয়সী প্রথম মেয়ে পাশের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। মেঝো মেয়ে স্থানীয় মাদরাসায় পড়ে। সবার ছোট দু’বছরের ছেলে।
বিয়ের পর প্রথম জীবনে যৌতুক না আনার অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ির যৌথ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। অনেক কষ্টে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। ছোটবেলায় নিজ চোখে নদীতে বাপ-দাদার বসতবাড়ি বিলীন হতে দেখেছে। বাবার বাড়িতেও ঠাঁই নেই। শহরে এসে ভালোই কাটছিল রহিমার জীবন। হঠাৎ এক ঝড় এসে যেন তার জীবন-সংসার তছনছ করে দেয়।
স্বামী রূপবান সেখের চলাফেরায় কিছু পরিবর্তন দেখতে পায়। লাল শার্ট গায়ে রিকশা চালানো দেখে রহিমার মন খারাপ হয়ে যায়। রাতে রিকশা চালানোর কথা বলে অধিক রাতে বাড়ি ফিরে। রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরার কথা জানতে চাইলেই সে উত্তেজিত হয়ে যায়। স্বামীর উত্তেজনা অতীতে শ্বশুরবাড়িতে থাকা অশান্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। তবুও সব নীরবে সহ্য করতে থাকে। ইদানীং রূপবান সেখের অন্যত্র রাতযাপনে চিন্তিত হয়ে পড়ে রহিমা। দারিদ্র্য থাকলেও সংসারে সুখের কোনো ঘাটতি ছিল না। দু’বেলা পেট পুরে খাওয়াই যেন তাদের অনেক প্রাপ্তি।
রহিমা কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। তার মনে পড়ে বিয়ের দিনের প্রতিশ্রুতির কথা। রহিমার হাত ধরে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে স্বামী বলেছিল ‘তুমিই আমার জীবনসাথী’। স্বামী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। ডাক্তার তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক দিকে রহিমা, অন্য দিকে মৃত্যু। সে লড়াইয়ে রহিমার জয় হয়েছে। একজন নারীর জীবনে স্বামীই যেন সব। কর্মক্ষম স্বামী, পাশে একজন প্রেরণাময়ী নারী, তা হলে সুখ-সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
সুখ-দুঃখের স্বপ্নে গাঁথা রহিমার দাম্পত্য জীবন। স্বামী সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ওকে নিয়ে শহরের সব অলিগলি চিনিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখে। শহরের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে গিয়ে ধনী দম্পতিদের মতো ওরাও ঝালমুড়ি খায়। সত্যিই রহিমা অনেক সুখী। স্বামীকে জীবন দিয়ে আগলে রাখে। এত সুখ সইবে কি না মাঝে মধ্যে চিন্তিতও হয়ে পড়ে রহিমা। একদিন রূপবান সেখের ধার করা ফুলপ্যান্ট পরা দেখে রহিমার সন্দেহ আরো প্রবল হয়ে ওঠে।
স্বামীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সে। অবশেষে তার সন্দেহ সত্যি হলো। রূপবান সেখ স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে পাশের বস্তির এক স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে বিয়ে করেছে। শ্বশুরবাড়িতে দরজা বন্ধ করে উচ্চ শব্দে গান শুনছে। এ দিকে রহিমার হৃদয় ভাঙা আর্তচিৎকারে ওই বাড়ি যেন প্রকম্পিত। রূপবান রেগে আগুন। তার নতুন শ্বশুরবাড়িতে রহিমার উপস্থিতি। তাও উচ্চস্বরে চিৎকার, এটা যেন জঘন্যতম অপরাধ। এই অপরাধ ‘ক্ষমার অযোগ্য’। একজন মুসলিম পুরুষ চারটি বিয়ে করা অন্যায় নয়Ñ এই রকম কথিত যুক্তি ধর্মীয় বিধানের সাথে মিশ্রিত করে রূপবান এ বিয়েকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করে। একে একে পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হলো; যার যার মতো করে যুক্তি আর সান্ত্বনা দিলো। সবাই একমত, রূপবান যদি ভরণপোষণের ক্ষমতা রাখে, সমতার দৃষ্টি রাখে, তা হলে আরো দুটি স্ত্রী নিতে বাধা কোথায়?
রহিমা পাগলের মতো বিচারের জন্য ছুটে বেড়ায় এখানে-সেখানে। ছিন্নভিন্ন হৃদয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। শত দারিদ্র্য, কষ্ট আর অভাবের মাঝেও স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল না। একটা ছেঁড়া কাপড়, অন্যের বাসায় কাজ করে নিজে না খেয়ে স্বামীর জন্য অন্নসংস্থান, ঋণ করে তাকে রিকশা কিনে দেয়া, জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা ভাবনায় রহিমার বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীতে ভালোবাসার কথামালা কি মিথ্যা? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি এতই ক্ষণস্থায়ী! প্রেম, দয়া, ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভবিষ্যতÑ সবই কি বৃথা? স্বামী-স্ত্রীর প্রতিজ্ঞা, দু’জনের স্বপ্নের বুনিয়াদ, সবই কি মিথ্যা! রহিমার মন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বিষণœতায় ভারাক্রান্ত। বৃষ্টির মতো কাঁদতে ইচ্ছা করে। বৃষ্টির মাঝে বজ্রপাতের মতো অগ্নিকুণ্ডলি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিতে চায় রূপবানের দ্বিতীয় সংসার।
রহিমার জীবন কাহিনী মন দিয়ে শুনলাম। আইনি সাহায্য পেতে আমার চেম্বারে ওর আগমন। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫)(বি) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম স্ত্রীর বা সালিশি পরিষদের অনুমতি ব্যতীত একজন বিবাহিত পুরুষ প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে না। তবে প্রচলিত আইনে দ্বিতীয় স্ত্রী এই অপরাধের আওতায় পড়বে না। প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিয়েতে স্বামী শাস্তি পাবে, তবে কোনো স্ত্রী নয়। (৩৯ ডিএলআর ১৮১, ৩৮ ডিএলআর ১৪০)। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫) (এ) বলা হয়েছে, সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীর দাবি মতে, সমুদয় দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে ৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) অধীনে রেজিস্ট্রিকৃত হবে না। ফলে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫)(বি) ধারায় মামলা করা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় জটিলতা। দ্বিতীয় বিয়ে প্রমাণের মূল শর্ত হলো, দ্বিতীয় বিয়ের কাবিননামা। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে তো আইনগতভাবে রেজিস্ট্রিকৃত হবে না। কাজীরা বিষয়টি ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। ফলে শরিয়ত মতে কবুল পড়িয়ে, সাদা কাগজে নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে কাজীরা চলে যান। এভাবেই চলে ‘দ্বিতীয় বিয়ের সংসার’।
১০ বিএলডি (এডি) পৃষ্ঠা-২৫২ শেখ শামসুর রহমান
ওরফে শামসু বনাম রাষ্ট্র মামলায় বলা হয়েছে, শোনা কথা আইনত কোনো সাক্ষ্য নয়। অর্থাৎ এর কোনো মূল্যই নেই। ১৯৮৬ বিএলডি (এডি) পৃষ্ঠা ১ মো: খলিল উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় সিদ্ধান্ত আছে, আসামি তার নির্দোষিতা প্রমাণের আবশ্যকতা নাই। প্রসিকিউশন পক্ষকেই আসামির অপরাধ
প্রমাণ করতে হবে, ব্যর্থতায় আসামিকে খালাস দিতে হবে। এ দিকে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, কাবিননামা প্রমাণিত না হলে বিয়ে প্রমাণিত বলে গণ্য হবে না (৫৭ ডিএলআর ৭১৮)। অন্য দিকে উচ্চ আদালতের আরো সিদ্ধান্ত রয়েছে, রেজিস্ট্রি করা কাবিননামা না থাকলেও মুসলিম বিয়ে বৈধ হতে পারে। বিয়ে
বৈধ কি না প্রশ্নের মামলা পারিবারিক আদালতে রক্ষণীয় (৬ বিএলটি ৯২)।
রহিমার ক্ষোভ স্বামীর চেয়ে সতীনের দিকে বেশি। এ কেমন আইন? আমার স্বামীকে কেড়ে নিলো তার শাস্তি হবে না! অপরাধের ধারাও জামিনযোগ্য! রহিমাকে আদালতে গিয়ে বিচার চাইতে হবে। দ্বিতীয় বিয়ের কাবিননামা দেখাতে হবে। আইনজীবী, মহুরি, পথভাড়া, পেশকার, পিয়ন, সর্বোপরি রিকশার কিস্তির টাকা সব কিছু শুনে সে নির্বাক। আইনজীবীর খরচ বাদ দিয়ে আইনি সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিলাম। আদালতে যাওয়া-আসার পথভাড়াই তার নেই। মামলা করবে কিভাবে?
বিচার চাইতে টাকা খরচ করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা পেতে টাকা খরচ করতে হয়। শিক্ষা অর্জনের জন্য টাকা খরচ করতে হয়। সরকারি সব সেবা পেতে টাকা খরচ করতে হয়। তা হলে রহিমার জীবনে রাষ্ট্রের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে? রহিমা জানতে চায়, আসামি ধরার সাথে সাথে বিচার ও সাজা একই দিনে শেষ হবে কি না? সর্বশেষ আইনি প্রতিকার পেতে কতদিন সময় লাগতে পারে, এত বড় অপরাধের মামলা জামিনযোগ্য কেন? নানা প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে ফেলে রহিমা।
অবশেষে রহিমার বিচারপ্রার্থী হওয়ার আকাক্সক্ষা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। রূপবান সেখের দেখানো সব স্বপ্ন রহিমার জীবনে মিথ্যা বালুচরে পরিণত হয়। রহিমার ঘরভাড়া বাকি পড়ে যায়। স্বামী ও সংসারহারা হয়ে তিন সন্তানসহ এনজিওর কিস্তির টাকা বাকি রেখেই গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু। শুধু স্বামীর পাশবিকতায় চারটি জীবন অনিশ্চয়তার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রের আইনের আর রহিমার জীবনে কোনো গুরুত্ব নেই। যে সমাজে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এক দুর্লভ প্রক্রিয়া, সেই দেশে রহিমার বিচারপ্রাপ্তি কি নিশ্চিত হবে?
রহিমার আইন প্রাপ্তির সুবিধা রাষ্ট্রীয়করণ করা এখন সময়ের দাবি মাত্র। এই দাবি তার সুযোগ নয়, জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার। হ
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
seraj.pramanik@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
কাতারের সাথে যৌথ বাণিজ্য কাউন্সিল গঠনে এফবিসিসিআইয়ের চুক্তি টি-২০ খেলতে সিলেটে পৌঁছেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল খুলনায় হিটস্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র? জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় গাজীপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলির নিন্দা জামায়াতের রাজধানীতে তৃষ্ণার্তদের মাঝে শিবিরের বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ রাজশাহীতে সাড়ে ৬ কোটি টাকার হেরোইনসহ যুবক গ্রেফতার

সকল