২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির অবসান জরুরি

-

ঋণখেলাপি সংস্কৃতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম বাধা হিসেবে অভিহিত, যা অর্থনৈতিক কার্যধারাকে মূল্যহীন করে দেয়। ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার ঋণ যা আদায় করা হয়নি, ফলে দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ঋণখেলাপিরা ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে রাতারাতি দামি গাড়ি বাড়ির মালিক বনে যায়। জনসাধারণের একটি বিশেষ অংশ বিভিন্নভাবে ঋণ গ্রহণ করে থাকে আবার স্বেচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে ঋণখেলাপিও হয়ে থাকে, যা একটি সংক্রামক ব্যাধির মতো আত্মপ্রকাশ পেয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য সংগৃহীত আমানত থেকে ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু খেলাপি সংস্কৃতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান জামানত গ্রহণ করে থাকে। যাকে বন্ধক বলা হয়। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনে ‘বন্ধক’ বলতে ঋণ করার উদ্দেশে স্থাবর সম্পত্তির স্বত্ব হস্তান্তরকরণকে বোঝায়। বন্ধকদাতা এই মর্মে সম্পত্তি বন্ধক রাখেন যে, ঋণের টাকা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হলে বন্ধক গ্রহীতা অতঃপর দাতার রক্ষিত সম্পত্তিটি দাতার বরাবরে ফেরত দিতে বাধ্য। ঋণ দেয়ার আগে প্রথমে তারল্য সঙ্কটের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। তারল্য সঙ্কটে পড়তে হবে কি না। বিনিয়োগকৃত বা ঋণের টাকা কত সময়ে উঠে আসবে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত পর্যাপ্ত কি না বিবেচনা করে দেখতে হবে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জামানতের সম্পত্তি বা বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের প্রদত্ত অর্থ ফিরে পাবে কি না, সেটা বিবেচনায় রাখা হয়। মুনাফার সম্ভাবনার, ঋণ বা বিনিয়োগ খাতটি কতটুকু লাভজনক তা বিবেচনা করতে হবে। ঋণ দেয়ার আগে ঋণগ্রহীতার আগের রেকর্ড অর্থাৎ সামাজিক সুনাম, পুলিশ রেকর্ড বা ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা যাচাই করতে হবে। অতীতের রেকর্ড খারাপ থাকলে ঋণ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা, ব্যবসায়িক দক্ষতা দেখা জরুরি। এমন খাতে ঋণ দিতে হবে যা দেয়া হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দরিদ্র, মূলধন, সামর্থ্য, নির্ভরশীলতা, দায়িত্বশীলতা ও সম্পদশীলতা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ দেয়া যাবে না। ঋণ বা বিনিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ব্যাংক কর্তৃক অলিখিত চার্জ ডকুমেন্টে ঋণগ্রহীতা ও জামিনদারের স্বাক্ষর গ্রহণের দীর্ঘ দিনের বেড প্র্যাকটিস বন্ধ করতে হবে। চার্জ ডকুমেন্ট এক বসায় এক হাতে এক কলমে পূরণ করতে হবে। ঋণখেলাপিরা যাতে প্রতারণা ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে আইনে সে ব্যবস্থার পাশাপাশি ঋণ বা বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের যুগে যুগে চলে আসা ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে রুখতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাপক বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ কে আরো গতিশীল করতে হবে। ভদ্রবেশী ঋণখেলাপিদের হাতে যাতে দরিদ্র জনগণের অর্থ না যায় তার জন্য সচেতন থাকতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারসহ পর্যবেক্ষক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃত সৎ, পরিশ্রমী, মেধাবী ও যোগ্য ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয় ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধাসহ প্রণোদনা ও উৎসাহ দিতে হবে। ঋণ গ্রহণের উদ্দেশে প্রস্তাবকৃত জামানত বা সম্পত্তির প্রকৃতি যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সম্পত্তি কারো কাছে দায়বদ্ধ আছে কি না বা আগে কোথাও বন্ধক দিয়েছে কি না তা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের মাধ্যমে যাচাই করা জরুরি। ওই সম্পত্তি সংক্রান্তে আরএস রেকর্ডের মালিক থেকে স্বত্বের ধারাবাহিকতা মিলিয়ে দেখতে হবে। স্বত্বের ধারাবাহিকতার সংশ্লিষ্ট সব বায়া দলিল, আরএস খতিয়ান, বিএস খতিয়ান, দায়মুক্ত সনদ, বিএস নামজারি খতিয়ান, ডিসিআর, হালসন খাজনা পরিশোধের দাখিলা, সিডিএ অনুমোদনপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), হাউজিং সোসাইটির প্লটের ক্ষেত্রে এনওসি বা অনুমতিপত্র, সার্ভে রিপোর্ট বা আরএস দাগের সাথে বিএস দাগ মিলামিল সংক্রান্ত সংবাদের দরখাস্ত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট খতিয়ান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এসি (ল্যান্ড) বা সংশ্লিষ্ট কালেক্টরেটের রেকর্ডরুমে তল্লাশিক্রমে সঠিক আছে কি না যাচাই করে দেখতে হবে। জমির স্কেচ ও চৌহদ্দি নির্ধারণসহ তফসিলভুক্ত সম্পত্তিতে মালিকের সরেজমিন পৃথক চিহ্নিত মতে বাস্তব দখল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। সম্প্রতি খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ দেয়া, শাখা পর্যায়ে ঋণ দেয়ারর ক্ষমতা সীমিতকরণ, ঋণ পুনঃতফসিলকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পরিশেষে বলব, আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। করোনার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিমুক্ত করতে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। সঙ্কট মোকাবেলায় খেলাপি ঋণ আদায়সহ নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। হ
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement