২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি

-

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনা মহামারী। বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল একযোগে যুদ্ধ করছে নবাগত সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে। এখন পর্যন্ত আসেনি ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কার্যকরী কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন। পুরনো বিভিন্ন রোগের জন্য ব্যবহৃত রেমডেসিভির, ফ্যাভিপিরাভির, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, লোপিনাভির-রিটোনাভির, সারিলিমাব, ইভারমেকটিনের মতো অনেকগুলো ওষুধ নোবেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী কি না, তা নিয়ে চলছে পরীক্ষামূলক গবেষণা। ১১৪ টিরও বেশি ভ্যাকসিন নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, জার্মানির মতো বেশ কিছু দেশে। ওষুধ বা ভ্যাকসিনের মতোই করোনা চিকিৎসার আরেকটি গবেষণামূলক পরীক্ষা হলো প্লাজমা থেরাপি।
আমাদের রক্ত দুইটি অংশে বিভক্ত। এর একটি রক্তরস বা প্লাজমা, আরেকটি হলো রক্তকণিকা। প্লাজমা হলো হালকা হলুদাভ বর্ণের এক ধরনের তরল পদার্থ। আমাদের দেহের মধ্যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা বহিরাগত কোনো বিষাক্ত উপাদান প্রবেশ করলেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেহকে রক্ষার জন্য জীবাণুর বিরুদ্ধে সাড়া দেয়। রক্তের শ্বেত রক্তকণিকার বি লিমফোসাইটগুলো জীবাণুটিকে মেরে ফেলতে একধরনের প্রোটিন উৎপাদন করে, যার নাম অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডিগুলো জীবাণুকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তার রোগ ছড়ানোর ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। আমাদের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রমিত জীবাণুর তুলনায় শক্তিশালী হলেই অ্যান্টিবডিগুলো জিতে যায় এবং একজন রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। একবার এই অ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু হলে দেহে অনেক দিন ধরে তা চলতে থাকে এবং জীবাণুকে দেহ থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করে দেয়। এই অ্যান্টিবডিগুলো আবার রক্তের প্লাজমাতেই অবস্থান করে। তাই কোনো রোগ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া রোগীর প্লাজমা নতুন আক্রান্ত কোনো রোগীর দেহে সঠিক নিয়মে সঞ্চালন করতে পারলে অ্যান্টিবডিগুলো নতুন রোগীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে আরো অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে এবং ঐ নির্দিষ্ট রোগের জীবাণুকে মেরে ফেলার যুদ্ধ শুরু করে। এই বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলা হয় প্লাজমা থেরাপি।
প্লাজমা থেরাপি বহু পুরাতন একটি চিকিৎসা কৌশল। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর চিকিৎসায়, ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়েছিল এই পদ্ধতি। সাম্প্রতিক সময়ের সার্স ভাইরাস এবং ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসায়ও প্লাজমা থেরাপির কার্যকারিতা ছিল সন্তোষজনক। নবাগত করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যেহেতু কার্যকরী কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই, তাই পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে প্লাজমা থেরাপি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ প্লাজমা থেরাপি ইতোমধ্যে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা দাবি করছেন, এতে ইতিবাচক ফল মিলছে। অনেক রোগীই সুস্থ হয়ে উঠছে। তবে প্লাজমা থেরাপি নিয়েও মারা গিয়েছে, এমন রোগীও রয়েছে বেশ। তাই প্লাজমা থেরাপি চূড়ান্ত কোনো চিকিৎসা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বলছে, কোভিড-১৯ রোগের জন্য প্লাজমা থেরাপি একটি ‘ইনভেস্টিগেশনাল থেরাপিওটিকস’ যা কেবল পরীক্ষামূলকভাবেই প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর প্রয়োগের জন্য একটি জাতীয় বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটি গঠনেরও নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা: মহিউদ্দিন আহমেদ খানের নেতৃত্বে প্লাজমা থেরাপি বিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে দেশের বেশ কিছু করোনা রোগীর দেহেও প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়েছে।
এখন প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি কোনো প্রমাণিত চিকিৎসা নয়, বরং একটি ট্রায়ালমাত্র। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো যে, কোন ধরনের কোভিড-১৯ রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেয়া হবে? এই থেরাপি সব করোনা রোগীর জন্য নয়। কেবলমাত্র মারাত্মকভাবে সংক্রমিত রোগীকেই প্লাজমা থেরাপি দেয়া হবে। যেসব রোগীর রক্তে অক্সিজেনের সম্পৃক্ততা ৯৩ শতাংশের কম, তাদেরকে এই আওতায় রাখা হবে। করোনায় সংক্রমিত হয়ে যারা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট অনুভব করছেন বা আইসিইউতে আছেন, এমন রোগী ছাড়া কাউকেই এই থেরাপি না দেয়ার আন্তর্জাতিক নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয় যে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো রোগীর অনুমতি। যেহেতু প্লাজমা থেরাপি একটি পরীক্ষামূলক চিকিৎসামাত্র, তাই চিকিৎসককে এই চিকিৎসার বিষয়ে রোগীর এবং রোগীর পরিবারের অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। চতুর্থ বিষয়টি হলো থেরাপির পর রোগীর শারীরিক অবস্থা মনিটরিং করতে হবে এবং সারাংশ নথিভুক্ত রাখতে হবে।
তাই করোনায় আক্রান্ত হলেই কেউ প্লাজমা সংগ্রহের জন্য যেন উঠেপড়ে না লাগেন। কারণ করোনায় আক্রান্তদের শতকরা ৮০ ভাগ বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে যান। বাকি ২০ ভাগকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার হলেও প্রায় ৫ থেকে ৭ ভাগ রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়। ঠিক এই সঙ্কটাপন্ন রোগীর জন্যই প্রয়োগ করা হবে প্লাজমা থেরাপি।
রোগীর বিষয় তো গেল! এবার প্লাজমা ডোনারের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। প্রথমেই জানা যাক, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলেই কি কেউ প্লাজমা দিতে পারবেন? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, ‘না’। ডোনার হতে হলে করোনা রোগীর সুস্থ হওয়ার পরও ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পার হতে হবে। এক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আবার মৃদু সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা কোভিড-১৯ রোগীর রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কম থাকবে। সেজন্য তীব্রভাবে সংক্রমণের পর সুস্থ হওয়া রোগীকেই প্লাজমা ডোনার হিসেবে বাছাই করলে ভালো ফল মিলবে। কারণ তাতে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি থাকবে বেশি। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির টাইটার বা পরিমাণ পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হয়। এছাড়া প্লাজমা ডোনারের রক্তে অন্য কোনো জটিল রোগের সংক্রমণ আছে কি না-তা যাচাই করে তবেই তা নতুন রোগীর জন্য প্রয়োগ করতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, কতটুকু প্লাজমা রোগীর দেহে সঞ্চালন করতে হবে? এক্ষেত্রে সাধারণ নির্দেশনা হলো, এক ব্যাগ বা ২০০ মিলিলিটার প্লাজমা রোগীর দেহে প্রয়োগ করতে হবে। তবে চিকিৎসক রোগীর শ্বাসকষ্ট ও সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনা করে ২ ব্যাগও দিতে পারেন। তবে সেটি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ সাপেক্ষে। তাই প্লাজমা ডোনারদের কাছ থেকেও সেই অনুপাতে প্লাজমা সংগ্রহ করার পর সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করতে হবে।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, প্লাজমা দান আমাদের বাংলাদেশে তেমনভাবে পরিচিত নয়। তাই করোনা থেকে সুস্থ অনেক রোগীই প্লাজমা দানের ব্যাপারে অনাগ্রহী থাকতে পারেন। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, এটি রক্তদানের মতোই সাধারণ একটি ব্যাপার।
আসলে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি একটি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ মাত্র। তাই এটি নিয়ে অতি আগ্রহী হয়ে রোগী ও রোগীর পরিবারকে বাড়াবাড়ি করলে চলবে না। নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে এই ট্রায়ালটি সম্পন্ন করবেন প্লাজমা থেরাপি বিষয়ে সরকার গঠিত কারিগরি কমিটি। তাদের এই ট্রায়ালটি সফল হলেই কোভিড-১৯ রোগে আমরা একটি প্রমাণিত চিকিৎসা পাবো। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্রুতই প্লাজমা থেরাপির সফলতা প্রমাণিত হোকÑ এমনটিই এখন সবার প্রত্যাশা। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, ফার্মাসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক

সকল