২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বঙ্গবন্ধু জাপানের মডেলে বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন

-

অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে ব্যাপক ব্যবধান সত্ত্বে¡ও এশিয়ার দু’টি দেশÑ বাংলাদেশ, জাপানের সরকার ও জনগণের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক সুদৃঢ়করণ ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সম্প্রসারণের ঐকান্তিক ইচ্ছা অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যস্বার্থ দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের আধুনিক পর্যায়ে প্রাধান্য পেলেও বর্তমান সম্পর্কের ভিত্তি সুদীর্ঘ সময়ের গভীরে প্রোথিত। ওইসিডি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শিল্পোন্নত জাপানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় জাপান তখনো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রভাববলয়েরই একটি দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তির বদৌলতে জাপান ওকিনাওয়া দ্বীপের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় সে বছর। ১৯৭২ সালেই জাপানের সাথে চীনের দীর্ঘ দিনের বিরোধ প্রশমিত হয়ে সিনো জাপান কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের মিত্রদেশ হিসেবে বিপরীত অবস্থানে ছিল। ঠিক এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাপানের সরকার ও জনগণের সমর্থন এবং বিজয়ের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে জাপান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যবাহী ও সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের সাথে জাপানের মিত্রতা ও সখ্য গড়ে তোলার এই উদ্যোগ ও প্রয়াসের পেছনে প্রেরণার স্থপতি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)।
জাপান বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে জাপানিদের মধ্যে তাকাশি হায়াকাওয়ার (১৯১৭-১৯৮২) অবিস্মরণীয় অবদানের কথাও চিরস্মরণীয়। হায়াকাওয়ার তাৎপর্যপূর্ণ এ ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে বিশেষ সম্মান ও গুরুত্বের সাথে অনুসরণ ও উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকাশি হায়াকাওয়া একটানা ৪০ বছর জাপানের জাতীয় সংসদের ‘ডায়েট’ নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং ‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি তিন দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ তাকাশি হায়াকাওয়ার চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। জাপানের ডায়েটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে হায়াকাওয়া বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে হায়াকাওয়া তার প্রতি জাপান সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ এবং বিশেষ করে জাপানি জনগণের প্রতিবাদ জানানোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাপানি মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের সমর্থন সমন্বয়ে জাপানের বুদ্ধিজীবী, শিল্পমালিক, শ্রমিক ও ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত পাকিস্তানি গবেষক আহমদ রশিদ মালিকের Pakistan-Japan Relations শিরোনামে গবেষণা গ্রন্থটিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালিদের প্রতি জাপানিদের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রেক্ষাপট এবং সে কারণে পাকিস্তানের সাথে সে সময় জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের হতাশাজনক পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে এভাবেÑ
It is not difficult to assess what benefits there could be for Japan for its sympathetic attitude toward Bengali grievances. Japan had very large economic interests in the former East Pakistan.... The Japanese with the experience of Pakistan felt more at home in East Pakistan. Therefore, the Japanese developed sympathy for Bengali nationalism and self determination. Japan rallied support for the cause of Bangladesh long before its formal recognition. Civil Society in Japan, media and even political parties extended support to the cause of Bengali nationalism. (chapter Convergence and divergence: 1971-77' page 78)
আহমদ রশীদ মালিক আরো উল্লেখ করেছেনÑ
'Takshi Hayakawa, a Diet Member, was an outspoken advocate for the cause of Bangladesh. The Japanese Red Cross (Seki Juji) provided 1,000,000 rupees in aid to Bengali refugees who fled to India. To support the 'liberation war' in East Pakistan, a fund was raised in the district of Ginza in Tokyo in 1971, which was sponsored by Hayashi Tokako and other Diet Members. ( page 79)
সে সময়ে জাপান প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রয়াস-প্রচেষ্টার সাথেও একাত্ম হয়েছিলেন হায়াকাওয়া।
'Banguradesu to no Deai-Minzoku to Kokkyo wo Koette' ev Encounter with Bangladesh -Transcending Racial and Territorial Boundaries. (টোকিও, ১৯৮২) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেনÑ
'My concern about Bengal (Bangla), the opportunity of which was provided to me by the cyclone [of 1970], was bound to increase through the aggravation and surfacing of the confrontation and conflict between the Bengali people of East Pakistan and West Pakistan.' (মূল জাপানি থেকে বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ শেখ আহমদ জালাল কৃত ইংরেজি অনুবাদ)।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমেরিকা বলয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়Ñ হায়াকাওয়ারই প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। হায়াকাওয়া লিখেছেনÑ
At that time, I welcomed the birth of Bangladesh and started to move with the Japanese Government, together with my fellow Members of the Parliament and Government leaders, to recognize the newborn Bangladesh even a single day earlier. Fortunately, the Government also took a quick decision and extended recognition to Bangladesh in advance of many other countries.
স্বীকৃতি দানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৩-১৪ মার্চ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধিদল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সাতোর কাছে পেশ করা রিপোর্টে তিনি প্রস্তাব রাখেন (ক) বাংলাদেশেকে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান অবিলম্বে প্রদান এবং (খ) পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা। তার সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ২৮ মার্চ ১৯৭২ তারিখে জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। ওই বছর ৬ জুন জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এবং কিছুকাল পরে জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হলে হায়াকাওয়া তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন এবং আমৃত্যু এর নেতৃত্বে ছিলেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপানে বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শীর্ষ পর্যায়ের প্রথম সফরের সময় বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে যে সুযোগ সৃষ্টি হয় হায়াকাওয়া ছিলেন তার অন্যতম রূপকার। ২৩ অক্টোবর ১৯৭৩ সন্ধ্যায় টোকিওতে তার সম্মানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা ও তার স্ত্রী প্রদত্ত Banquet ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেনÑ
'My people recall with gratitude the sympathy and support extended to us by the people of Japan during critical days of our liberation war. We are equally grateful for the generous assistance extends to us by Japan in the period after liberation. We deeply appreciate the support extended to us by Japan in various international forums including the United Nations . The relations between our two countries are already marked by a feeling of deep understanding and friendship, and I sincerely hope that the areas of cooperation between our two countries in various fields will expand progressively.'
বঙ্গবন্ধুই এশিয়ার জাপান ও বাংলাদেশ (যে দুই দেশের জাতীয় পতাকায় সবিশেষ মিল লক্ষ করা যায়) এই দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী প্রতিষ্ঠার প্রথম রূপকার। বাংলাদেশ থেকে জাপানে বঙ্গবন্ধুর শীর্ষ সফরের সময় জাপান-বাংলাদেশ আর্থিক সহযোগিতার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। যমুনা সারকারখানা কর্ণফুলী সারকারখানা, যমুনা সেতুসহ কয়েকটি বড় প্রকল্প জাপানি অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে হায়াকাওয়া স্মৃতিচারণ করেছেনÑ
‘জাপান সফরের সময় শেখ মুজিবুর রহমান স্বভাবগতভাবেই ইচ্ছা প্রকাশ করে কয়েকবার বলেন, তিনি জাপানের মডেলে তার বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন। তাকে স্বাগত জানিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তানাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেনÑ ‘তিনি যেন আমাদের হিরোভূমি ইতো [হিরোভূমি ইতো জাপানের গৌরবোজ্জ্বল মেইজি যুগের প্রধান জাতীয় নেতা ছিলেন]। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপান চেম্ব^ার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট শিগেও নাগানো তৎক্ষণাৎ বলেনÑ ‘না, তিনি বরং একাধারে হিরোভূমি ইতো এবং তাকামোরি সাইগো’ [তাকামোরি সাইগো ছিলেন মেইজি জাপানের আরেক অবিসংবাদিত স্থপতি]। এই সমস্ত মহাজন মন্তব্যের স্মৃতি এখনো আমার কাছে সজীব। এমনকি ওহিরার মতো স্বল্পভাষী জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন, আমাকে বলেছিলেনÑ ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আজকের পৃথিবীর প্রধান তিনজন রাজনৈতিক নেতার একজন।’ এভাবে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত আত্মিক সম্পর্কের পাশাপাশি জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা ও বন্ধনের সূত্রপাত হয় শেখ মুজিবের জাপান সফরের সময়।
১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর হায়াকাওয়া সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এলে রাষ্ট্রাচার উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে পদ্মা গেস্ট হাউজে তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও সম্মান প্রদর্শনে আসার ঘটনাটিকে জাপান-বাংলাদেশের মধ্যে সুদূরপ্রসারী সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সোপান বলে হায়াকাওয়া তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেনÑ
Immediately changing our travelling outfits, we decided to start our daily schedule. The first thing was a courtesy call on Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman. But an absolutely unusual event took place. Beyond our expectations, Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman himself came to the State Guest House to visit us instead , accompanied by Foreign Minister Dr Kamal Hussain, Commerce Minister A H M Kamruzzaman, Minister of State Mr Nurul Islam, Political Adviser Mr Tofael Ahmed and other prominent Government leaders. Holding my hands in grip, Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman said, You are my truly and respectable and affectionate friend. You are also a friend of Bangladesh. I do not care for diplomatic formalities to meet you'. And he did not release my hand from his grip. This kind of sentiment one can not have frequently in one's life.
এ সফরের সময় হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে সফরকারী জাপানি প্রতিনিধিদলের কাছে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানি সহায়তার আহ্বান জানানো হয়। ওই সফরের একপর্যায়ে প্রতিনিধিদল ভোলায় গেলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ (১৯৪৩) এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ (১৯২২-২০০৫) হায়াকাওয়াকে ‘মি. বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করলে তিনি অভিভূত হন। স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেছেনÑ এ যেন নিজের নির্বাচনী এলাকায় সংবর্ধিত হচ্ছি। পরবর্তীকালে জাপানের জনগণ ও সরকারের কাছে তিনি ‘মি. বাংলাদেশ’ হিসেবেই আমৃত্যু পরিচিতি পেয়ে গর্ববোধ করেছেন এবং যখনই জাপানের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কিংবা যেকোনো সহায়তা ব্যাপারে দেনদরবারের বা নেগোসিয়েশনের প্রসঙ্গ উপস্থিত হয়েছে, তিনিই বলতে গেলে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৮২ সালে তার তিরোধানের পর আমরা জাপানের সাথে যখনই কোনো দেনদরবার করতে গেছি, হায়াকাওয়ার অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর পেয়ে বিচলিত বিমর্ষ হায়াকাওয়া টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে এসে অনুরোধ জানান, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র পিতৃ-মাতৃহারা শেখ রাসেলকে তিনি পেতে চান। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় শেখ রাসেল (১৯৬৪-১৯৭৫) ও শেখ রেহানা (১৯৫৭) জাপান সফর করেছিলেন। হায়াকাওয়া জানতেন না পিতার সাথে শেখ রাসেলও নিহত হয়েছেন। ২৬ আগস্ট ১৯৭৫ টোকিওতে জাপান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত শোকসভায় হায়াকাওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা তার স্মৃতিকথায় সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রতি জাপানের জনগণ ও সরকারের গভীর শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে তাতে। টোকিও বাংলাদেশ দূতাবাস টোকিওতে দোভাষী ইসামু শিরাইয়ের সহায়তায় মূল জাপানি থেকে আমার অনুবাদ করা হায়াকাওয়ার বক্তৃতার কিয়দংশ নিচে উদ্ধৃত হলোÑ
‘আমার অন্তরঙ্গ ও অত্যন্ত সম্মানিত বন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন জাতির পিতা এবং জনগণ যাকে আন্তরিকভাবে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করত, গত ১৫ আগস্ট কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে, ৫৬ বছর বয়সে, সপরিবারে নিহত হয়েছেন। এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি যখন আমি পাই, তখন এক অবর্ণনীয় শোকে ও বেদনায় আমি মুহ্যমান হয়ে পড়ি।
আমাদের দেশেও অতীতে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা একবার ঘটেছিল যা ৫.১৫ এর ঘটনা [১৯৩২ সালের ১৫ মে জুনিয়র সামরিক অফিসারদের অভ্যুত্থান] নামে খ্যাত, সেদিন প্রধানমন্ত্রী মি. ইনুকি সেনা অফিসারদের বলেছিলেনÑ ‘আমি যা বলতে চাচ্ছি, আশা করি তোমরা তা বুঝবে’; উগ্র কর্মকর্তারা বলল, ‘এখন এসব যুক্তির কথার কোনো দরকার নেই’ এবং এ কথা বলেই তারা বয়োবৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে। আমি যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনলাম, তখন আমার ৫.১৫ এর ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বিদেশী বার্তা সংস্থা পরিবেশিত সংবাদ মতে, ১৫ আগস্টের খুব ভোরে মুসলিম প্রার্থনা বা নামাজ পড়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের আক্রমণের শিকার হন। তার নিজের ব্যক্তিগত বাসভবনের তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে তিনি আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেছিলেনÑ ‘ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, ভুট্টো (এরা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট) যেখানে আমাকে হত্যা করেনি, সেখানে তোরা এসেছিস আমাকে হত্যা করতে?’ তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হয়। আরেকটি বিদেশী বার্তায় দেখা যায়, ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহীদের অস্ত্রসমর্পণের শর্তে নিজে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, তার এই প্রস্তাবে হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর না পেয়েই তাকে নিহত হতে হয়।’ এটা একজন রাজনীতিকের সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল মূলত জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উৎসর্গকৃত। তিনি নিজের জীবনকে পাখির পালকের মতো হালকা মনে করতেন। তিনি জীবনে আটবার গ্রেফতার হন, কারাগারে কাটান সাড়ে ১০ বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সহযোগীদের পরিবর্তে তিনি নিজেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন, সেখানে ফাঁসিতে ঝোলার দুই ঘণ্টা আগে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, তিনি এভাবেই জাতীয় বীর হিসেবে এক সগৌরব জীবনের অধিকারী হয়ে জাতির পিতার সম্মানে সমাসীন হন।
মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে ঢাকায় লাখো জনতার সামনে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার সেই বক্তৃতার ভাষা আমাকে আপ্লুত করে। এখনো তা আমার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তিনি বলেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে আমি বুঝব জনগণের ¯েœহ ও ভালোবাসা আমার ওপর নেই, সে মুহূর্তেই আমি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকব। তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের সব মানুষের মুখে হাসি না ফোটানো পর্যন্ত আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে যাবো।’
দেশ ও জাতির প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও তার মন অনুধাবন করার জন্য অনেক কিছু বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে, উপর্যুপরী বন্যা, মূল্যস্ফীতি ও আরো কিছু সমস্যা, যার সাথে যোগ হয় কিছু শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতি, এসব কারণে সবার মুখে হাসি ফোটানোর সেই প্রতিশ্রুতি-প্রত্যয় পূরণ না করেই স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো, যদিও অনেক কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়।’ হ
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

 


আরো সংবাদ



premium cement
রংপুরে মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করায় ছাত্রলীগ কর্মী গ্রেফতার বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি, অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা বিশ্বের অন্যতম স্মার্ট হজ ব্যবস্থাপনা হবে বাংলাদেশে : ধর্মমন্ত্রী সিলেটে ৪৪ লাখ টাকার ভারতীয় চিনিসহ গ্রেফতার ৪ অবৈধ সম্পদ : এস কে সিনহার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ জুন টি-টোয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ে চাপম্যান-আফ্রিদির উন্নতি থানচিতে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের গুলি চীনের আনহুই প্রদেশের সাথে ডিএনসিসি’র সমঝোতা স্মারক সই আ’লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষ : ২ শতাধিক ককটেল বিষ্ফোরণ, আহত ৫ রাঙ্গামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে নিহত ৬, আহত ৮ প্রতিবাদ সমাবেশকারীদের গ্রেফতারের নিন্দা জামায়াতের

সকল