১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও স্কুলজীবন খোকা থেকে মিয়া ভাই

-

আঁকাবাঁকা মধুমতি নদীর সমীরণে এলোমেলো ঝাউবনের কিনারায় মমতার মতো ছায়া সুনিবিড়, শান্ত দুপুরের ঘুঘুডাকা নির্জনতার মতো দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। শেওলা ধরা লাল ইটের শত বছরের পুরনো দালানের পাশে টিনের ঘরে একদিন শুভ্রসন্ধ্যায় জ্বলে উঠেছিল একটি বাতি। সেই বাতির আলোর জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে হাজার বছরের বঞ্চনায় কালো ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। তার বেড়ে ওঠার উদ্দাম বাতাস আন্দোলিত করে তুলেছে সময়ের ঘুণে ধরা সংসার, তার উত্থিত তর্জনী নিয়ে আসে স্বাধীনতার মেঘের পাহাড়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। সময়ের আবর্তে শেখ মুজিবুর রহমান নামটি একটি ব্যক্তিত্বে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেই নাম হয়ে উঠেছে জাতির জনকে। হাজার বছরের রক্তঝরা শিকল এই একটি নাম ভেঙে গিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখন পৃথিবী জুড়ে বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ।
মোগল আমলের বহু আগে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন। সেই শেখ বংশে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রোজ সোমবার মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার আব্বার নাম শেখ লুৎফুর রহমান। দাদার নাম শেখ আব্দুল হামিদ। জনসাধারণ তাকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তার নানাও শেখ বংশের শেখ আব্দুল মজিদ।
শেখ পরিবারে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে যখন মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট নানা শেখ আব্দুর রশিদ চরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরেজি এম ই স্কুল, সেই এম ই স্কুলে মায়ের কাছে পাঠ শেষ করে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তার বাবা গোপালগঞ্জ শহরে দেওয়ানি আদালতে চাকরি করতেন। তিনি বাবার কাছে চতুর্থ শ্রেণীতে গোপালগঞ্জে পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের কোনো ভাই না থাকায় তার নানা সায়েরা খাতুনকে সব সম্পত্তি লিখে দেন। তার মা সম্পত্তির দেখাশোনা, গ্রামের মায়ায় শহরে স্বামীর সাথে থাকতেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা ও নানার বংশ একই হওয়াতে তাদের ঘর পাশাপাশি ছিল। বংশের বড় ছেলে হিসাবে শেখ মুুজিবুর রহমানের আদরে আহ্লাদে বড় হয়। বেশির ভাগ সময় তিনি তার আব্বার কাছে থাকতেন, আব্বার কাছেই ঘুমাতেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়Ñ‘আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না।’ শেখ মুজিবুর রহমান তার আব্বাকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন, ভয় পেতেন, আবার বন্ধুর মতো ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। সমাজ বিজ্ঞানের সামাজিকীকরণে একটা কথা আছে, যৌথ পরিবারের সন্তানরা দরদী, সামাজিক, আত্মত্যাগী, উদার মানবিকতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সেই সমাজব্যবস্থায় এতটাই মানবিক ছিলেন সবাই তাকে ‘মিয়া ভাই’ বলে ডাকতেন। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। কথিত আছে, একদিন খালি গায়ে স্কুল থেকে খোকা বাড়ি ফিরে আসে। মা জামাকাপড় কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘সহপাঠী একজনের গায়ে কিছু নেই তাই তাকে দিয়ে দিয়েছি।’
১৯৩৪ সালে বঙ্গবন্ধু সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বেরি বেরি রোগে (হাত-পা ফোলা) আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তার হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। তাকে কলকাতার শিবপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরী চিকিৎসা করেন। ১৯৩৬ সালে আবার চোখে গ্লুকোমা নামে এক ধরনের রোগ হয়। কলকাতায় তার প্রথম চক্ষু অপারেশন করে ডাক্তার তাকে চশমা ব্যবহার করতে বলেন। ১৯৩৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু চশমা ব্যবহার করেন। ১৯৩৬ সালে এক দিকে বঙ্গবন্ধুর অসুস্থতা অন্য দিকে শেখ লুৎফুর রহমান চাকরির কারণে মাদারীপুরে বদলি হয়ে চলে আসেন। তখন সায়েরা খাতুনকে মাদারীপুর নিয়ে আসা হয়। অসুস্থতার জন্য বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনা দুই বছর পিছিয়ে যায়। সপ্তম শ্রেণীতে পুনরায় মাদারীপুর হাইস্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়। ১৯৩৭ সালে তার বাবা আবার গোপালগঞ্জে ফিরে এলে তাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ সময় পরিবারের ইচ্ছায় ফজিলাতুন্নেছাকে বিয়ে করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচেতনতা মূলত পরিবার থেকে শুরু হয়। তার পরিবারের পূর্বপুরুষরা ছিলেন শিক্ষিত সমাজসেবক দরদী। শেখ বংশের শেখ কুদরতউল্লাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মি. রাইন নামে একজন ইংরেজ কুঠিয়ালের বিরুদ্ধে ইংরেজদের কোর্টে মামলা করে তাকে অপমান করার জন্য আধা পয়সা (এক পয়সা এক টাকার চৌষট্টি ভাগের এক ভাগ) জরিমানা করান। রাইন বলেছিল, ‘যত টাকা চান দিতে আমি রাজি আছি। আমাকে অপমান করবেন না।’ সে সময় আধা পয়সা জরিমানা মানে ভীষণ অপমান। শেখ কুদরতউল্লাহ (লোকেরা কদু শেখ বলে ডাকত) উত্তরে বলেছিল, ‘টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকা আমার দরকার নাই, তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছ, আমি প্রতিশোধ নিলাম।’ এই ঘটনা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ছোটকাল থেকে বঙ্গবন্ধু ‘আনন্দবাজার’, ‘বসুমতি’, ‘আজাদ’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ ইত্যাদি খবরের কাগজ পরিবারের ঐতিহ্যের কারণে ঘরে বসে পড়তেন। মাদারীপুরে বঙ্গবন্ধু প্রথম রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের (মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন) কারণে বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মাদারীপুরে স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুভাষ বোসের দল শক্তিশালী ভূমিকা পালন করত। যে সময় বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জে, মাদারীপুরে মিছিলে যোগ দিতেন। বঙ্গবন্ধু জমিদার তালুকদার ও মহাজনের শোষণ দেখেছেন। যেখানে অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু ছোটকাল থেকেই রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন।
ছোটকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু মানবদরদী ছিলেন। প্রাকৃতিক সহজাতভাবে তার মধ্যে মানবতা, দয়া, পরোপকার ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলি দেখা যায়। এমএসসির মাস্টার কাজী আব্দুল হামিদ লজিং মাস্টার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে আলাদা ঘরে তাকে পড়াতেন। সেই লজিং মাস্টার ছিলেন আবার মানবদরদী আরেক মানুষ। তিনি ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করে মুসলমান ছাত্রদের সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু সেই মুসলিম সেবা সমিতির সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। মুসলিম সেবা সমিতির কাজ ছিল প্রতি রোববার মুষ্টি ভিক্ষার (বাড়ি বাড়ি ভাত রান্নার সময় মুষ্টি পরিমাণ চাল জমানো) চাল তোলা; গরিব ছেলেমেয়েদের সাহায্য করা; বই, কাগজপত্র কিনে দেয়া; মুষ্টি ভিক্ষার চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের লজিং (জায়গির) ঠিক করা। বঙ্গবন্ধু এই সামাজিক কাজ এতটাই ভালোবেসেছেন, কেউ চাল না দিলে জোর করে আদায় করতেন, তাতেও না দিলে বাড়ির ঘরের চালে ঢিল মারতেন। এজন্য কখনো কখনো তার আব্বার শাসন শুনতে হতো তাকে। কাজী আব্দুল হামিদ যক্ষ্মা রোগে মারা যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই মুসলিম সেবা সমিতির হাল ধরেন এবং পরে তিনি এই সমিতির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল, বিভিন্ন কারণে তিনি পড়াশোনায় চার বছর পিছিয়ে যান। ফলে স্কুলে সবার বড় হিসেবে খেলার দলনেতা তিনিই থাকতেন। তার আব্বাও ভালো ফুটবল খেলতেন। আব্বার দল ও বঙ্গবন্ধুর দল এক সাথে একই মাঠে প্রতিপক্ষ হয়ে খেলাধুলা করত।
বঙ্গবন্ধু তার বন্ধুদের মধ্যেও অনেক প্রিয় ছিলেন, বন্ধুদের নিয়ে একটা দল ছিল তার। যেখানে যেতেন একসাথে যেতেন, মারপিট করা, খেলাধুলা, মিছিল ইত্যাদি ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। কোনো বন্ধুর কোথাও বিপদ হলে একসাথে সবাই গিয়ে তাকে সাহায্য করতেন। মানুষের বিপদ দেখলেই বঙ্গবন্ধু স্থির থাকতে পারতেন না। ছোট বয়স থেকেই নেতৃত্বের যোগ্যতা তার মাঝে ছিল চিরজীবন্ত।
১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধু অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তারা দু’জন এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গোপালগঞ্জে আসেন। সেই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু হিন্দু-মুসলমান সহপাঠীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু হিন্দু ছেলেরা কংগ্রেসের নিষেধ আছে বলে আলাদা হয়ে যায়। এতে বঙ্গবন্ধু মনে কষ্ট পান। তবু মুসলমান ছেলেদের দিয়ে সভা সফলভাবে শেষ করেন। সভা শেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুলে পরিদর্শনে গেলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, কাজ, যোগ্যতা তাকে আকৃষ্ট করে। তিনি খুশি হয়ে বঙ্গবন্ধুকে কাছে ডেকে নিলেন, আদর করলেন, ঠিকানা ডায়েরিতে টুকে নিয়ে কলকাতা গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুসলিম লীগ গঠন করার ব্যাপারে চিঠি লিখতেন। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে চিঠি লিখতেন। এভাবেই ছোটকাল থেকে বড় বড় মানুষের সাথে তার সখ্য তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কৈশোরেই তিনি খুব অধিকারসচেতন ছিলেন। একবার যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গোপালগঞ্জ সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশোর শেখ মুজিব তাঁর কাছে স্কুলঘর বর্ষার পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’
১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ ঘুরে চলে যাওয়ার পর হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে আড়াআড়ি দেখা যায়। অঘোষিতভাবে মুসলমানরা মুসলিম লীগ আর হিন্দুরা কংগ্রেসের পক্ষে অবস্থান করে। সে সময় অনেক হিন্দু মুসলমানদের ওপর প্রকাশ্যে অত্যাচার শুরু করে বিভিন্ন জায়গায়। শেখ মুজিবুর রহমানের এক সহপাঠী, যে তার বাবার বন্ধু খন্দকার শামসুদ্দীন হকের আত্মীয় নাম আব্দুল মালেক। তাকে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। এই কথা শোনামাত্রই শেখ মুজিবুর রহমান তার বন্ধুর দলবল নিয়ে হিন্দুর বাড়িতে যান এবং মালেককে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। রমাপদ দত্ত শেখ সাহেবকে গালি দিয়ে বসলে শেখ সাহেব তার তীব্র প্রতিবাদ জানান। রমাপদ থানায় খবর দিলে তিনজন পুলিশ আসে। এ দিকে খবর পেয়ে শেখ মুজিবের মামা শেখ সিরাজুল হক আরো লোকজন নিয়ে এসে শেখ মুজিবের সাথে যুক্ত হন। শুরু হয় তুমুল মারামারি। একপর্যায়ে শেখ মুজিব দরজা ভেঙে মালেককে নিয়ে আসেন। শুরু হয় পুরো শহরজুড়ে উত্তেজনা। হিন্দু-মুসলিম মুখোমুখি অবস্থান সৃষ্টি হয়। হিন্দু নেতারা থানায় বসে খন্দকার শামসুল হককে হুকুমের আসামি, শেখ মুজিবকে খুন করার চেষ্টা, লুটপাট, দাঙ্গা-হাঙ্গামার আসামি এবং শহরের নামীদামি গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের আসামি করে মামলা দেয়া হয়। সকাল ৯টার আগেই মামা শেখ সিরাজুল হক ও আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব ভয়ে পালিয়ে যাননি। থানার দারোগা বাড়ির সম্মানের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে পারছিলেন না। বাড়ির পাশে টাউন হলের মাঠে শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার ফুফাতো ভাই তাকে পাশের বাসায় সরে যেতে বলল। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘যাব না, আমি পালাবো না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।’ এক সময় দারোগা শেখ মুজিবুর রহমানের বাবার সাথে বাসায় এসে সব মামলার বিষয় খুলে বলেন, কাগজপত্র দেখালেন। বাবা বললেন, ‘নিয়ে যান’। তখন দারোগা একজন সিপাহি রেখে যান। শেখ মুুজিব খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজে থানায় এসে হাজির হন। কোর্ট দারোগা তার নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে তিনি সরাসরি তার প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বাজে কথা বলবেন না, ভালো হবে না।’ পরে অবশ্য ওই মিথ্যা বানোয়াট কথা এজাহারে দিয়ে তাকে জেলে প্রেরণ করা হয়। এ দিকে কলকাতায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী এই ঘটনা জানলেন। ১০ দিন পর পনেরো শ’ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সবাই জেল থেকে মুক্ত হয়। এটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে প্রথম জেল।
১৯৩৯ সালে বঙ্গবন্ধু নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করে গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করার বিষয় নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। খন্দকার শামসুদ্দীনকে সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পাদক করা হলো ছাত্রলীগের। আবার মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটিতে সেক্রেটারি করা হলো বঙ্গবন্ধুকে। এভাবেই তিনি ছোট বয়স থেকে নিজ যোগ্যতায় আস্তে আস্তে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪১ সালে ভীষণ অসুস্থ, গলা ফোলা, এক শ’ চার ডিগ্রি জ্বর নিয়ে শুয়ে শুয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন এবং কলকাতা চলে যান। পরে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। পরীক্ষার পরপরই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। সভা, মিছিল, বক্তৃতা সমাবেশ ইত্যাদি তার নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড হয়ে গেল। খেলাধুলায় আর মনোযোগ নেই। মনে তার একটাই স্বপ্ন, একটাই আশা মানুষের মুক্তি। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখিছেন, ‘পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’
গ্রামবাংলার একটা কথা আছে, সকালের সূর্য বলে দেয় সারা দিন কেমন যাবে। বঙ্গবন্ধুর ছোটকাল থেকে তার চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় তা হলোÑ মানবদরদী, বন্ধুপ্রীতি, ধর্মপ্রীতি, পিতামাতার বাধ্য সন্তান, উদ্ভাবনী, কর্মচঞ্চল, উদার মানসিকতা, তেজি, নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা, সাহসী, সত্যবাদী, যেকোনো স্থানে কথা বলা, বক্তৃতা দেয়ার সম্মোহনী যোগ্যতা, অপরকে সম্মানবোধ ইত্যাদি গুণ তাকে সকালের আলোকোজ্জ্বল সূর্যের মতো করে তুলেছে। তার হাত ধরে হাজার বছরের গ্লানি মুছে যাবে। মানুষ পাবে স্বাধীনতার আনন্দ, তা ছোটকালেই প্রকাশ প্রায়। হ


আরো সংবাদ



premium cement