২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পানি সঙ্কটই হবে প্রাণের সঙ্কট

-

নদীমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও জাতিসঙ্ঘের পানি-বিষয়ক সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশ পানির নিরাপত্তা ঝুঁকিতে প্রথম দিকের দেশ। জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে। অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে বহু নদী। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে দেখা দেবে লবণাক্ততা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল পড়বে মরুকরণের কবলে। এ ছাড়া প্রায় তিন কোটি মানুষ আছে আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত জনসংখ্যা বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সুপেয় (মিঠাপানি) পানির গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসঙ্ঘ ২০১০ সালে পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। অন্য দিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে ২০১৫ সাল থেকে পানি সঙ্কটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সঙ্কট ও সাইবার আক্রমণের ওপরে স্থান দিয়েছে। বর্তমানে পানি সঙ্কট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর পানির প্রায় ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ লোনা। মিষ্টিপানির পরিমাণ ২ দশমিক ৫ শতাংশ, যার দুই-তৃতীয়াংশ বরফ আকারে আছে। বাকি ভূগর্ভস্থ এবং মাত্র দশমিক শূন্য ৩ ভাগ সারফেস ওয়াটার (নদী বা খালবিলের পানি)। ইউনেস্কো ২০১৮ সালের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে জানিয়েছিলÑ ব্যবহার, সংরক্ষণ ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন না এলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫৭০ কোটি মানুষ পানি সঙ্কটে পড়বে। এমনটি হলে পানি নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ হওয়া বিচিত্র নয়।
গোটা পৃথিবীতেই যখন পানি নিয়ে এত উত্তেজনা; তখন বাংলাদেশের সময় এসেছে ‘পানি সঙ্কট’ সমস্যার সমাধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সঙ্কট। ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে নেমে গেছে পানির স্তর। এরই মধ্যে ২৬ নভেম্বর ২০১৯, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ছয়টি শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। প্রকট হয়ে উঠেছে লবণ-পানি সংমিশ্রণের আশঙ্কা। বাপা’র এক গবেষণা রিপোর্ট বলছে, ঢাকায় পানির স্তর এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫ ফুট ও রাজশাহীতে ১৮-১৯ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে সাগরের লোনাপানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসতে পারে। এমনটি হলে দেখা দেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তাই গভীর নলকূপ স্থাপনের ওপর অতিসত্বর আইনি তৎপরতা জরুরি।
পরিবেশবিদরা মনে করছেনÑ কৃষি, শিল্পকারখানা ও অন্য ক্ষেত্রে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার বাড়াতে পারলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদনদী, খালবিল এখন প্রায় পানিশূন্য। ভারতের সাথে ৫৪টি এবং মিয়ানমারের সাথে তিনটি নদীসহ মোট ৫৭টি নদীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জলসীমায় উৎপত্তি ও সমাপ্ত হালদা ও সাংগু নদী আছে। এসব নদনদীর শাখা-প্রশাখা মিলে প্রায় ৮০০ নদী থাকলেও তথ্য অনুযায়ী, ১২৮টি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে ৮০ শতাংশ সেচের উৎস নদনদী হলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। এর অন্যতম কারণÑ অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার কয়েক দশক কেটে গেলেও আজো হয়নি কোনো সুরাহা। সেচ প্রকল্পের জন্য নদীতে পানি দরকার তিন হাজার কিউসেক এবং নদীরক্ষায় পানি প্রয়োজন ন্যূনতম এক হাজার কিউসেক; তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০ কিউসেকে। ১৯৯০ সালে তিস্তা সেচ প্রকল্পে ৮৯ হাজার হেক্টর চাষাবাদ হলেও বর্তমানে নেমে এসেছে আট হাজার হেক্টরে। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আদালত আমাদের পক্ষে। তাই তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে। অন্য দিকে, ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ হাজার কিউসেক পানি না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভারতের বিশিষ্ট নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র জানিয়েছেন, সেচ ও জলবিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গঙ্গার অববাহিকার উজানে অনেক জায়গায় জলাধার নির্মিত হয়েছে। তা ছাড়া, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে গঙ্গা থেকে পানি টেনে নেয়া হচ্ছে। ফলে নিচের দিকে (ভাটিতে) পানি কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হয়ে যাবে; এতে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সিলেটের হাওরাঞ্চলসহ মেঘনা অধ্যুষিত জনপদ মহাবিপর্যের সম্মুখীন হবে। আর আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমগ্র বাংলাদেশ পড়বে চরম বিপাকে। তাই অতি দ্রুত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ের সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা দিতে হবে। ধেয়ে আসা পানি সঙ্কট নিরসনে রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, ব্যবহৃত পানি পুনঃশোধন করে কৃষিকাজে ব্যবহার, নাব্যতা বাড়াতে নদী খননের পাশাপাশি বর্ষার বিশাল জলরাশি কিভাবে ধরে রাখা যায়, সেসব প্রকল্প অবিলম্বে হাতে নিতে হবে; নতুবা অদূর ভবিষ্যতে পানি সঙ্কটই হবে প্রাণের সঙ্কট। হ
লেখক : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement