২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশ রেলওয়ে নিয়ে কিছু কথা

-

বাংলাদেশে ১৮৮টি রেলস্টেশন বন্ধ। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে বন্ধ করা হয়েছে ৪৪টি স্টেশন। ২০১৫ সালে বন্ধ করা হয়েছিল ১২টি। একইভাবে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে ২০০৭ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ১৬টি স্টেশন। আর বর্তমান সরকারের আমলে ২০১২ সালে এসে বন্ধ হওয়া স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০। পরে অবসরে যাওয়া কিছু স্টেশনমাস্টারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২০টি স্টেশন আবার চালু করা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট ও পাকশী বিভাগে শতাধিক স্টেশন প্রায় ১০ বছর বন্ধ রয়েছে। আর পূর্বাঞ্চলে ৬০টি স্টেশন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে সাত-আট বছর ধরে। বন্ধ হতে হতে আজ তা দাঁড়িয়েছে ১৮৮তে। এ দিকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে এসব স্টেশনের মূল্যবান জিনিসপত্রও হারিয়ে গেছে। চুরি হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ।
বন্ধ থাকা স্টেশনগুলোতে লোকাল ট্রেন থামে। কিন্তু জনবলের অভাবে নিয়মিত টিকিট বিক্রি করা সম্ভব হয় না। ২০০৬ সালে সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল। তখন ৮১ জনের প্যানেল তৈরি করে তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করেছিল কর্তৃপক্ষ। ওই সময় গণমাধ্যমে নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে ওই নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। পরে একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দিতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ১৪টি বন্ধ স্টেশন পার হতে আগের চেয়ে প্রতিটি ট্রেনের গড়ে প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় লেগে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরও ট্রেনের গতি আজো বাড়েনি।
শুধু স্টেশন সুপার ও মাস্টারের সঙ্কটের কারণে আংশিক বন্ধ আছে প্রায় অর্ধশত রেলস্টেশন। রেলের চাহিদা অনুযায়ী প্রায় ৪২ হাজার কর্মী থাকার কথা কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র সাড়ে ১৯ হাজারের মতো।
সর্বশেষ যোগ হয়েছে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ১২ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ সংক্রান্ত একটি ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক বিষয় হলোÑ এই রেলপথ নির্মাণের ব্যয় কিলোমিটার প্রতি কোথাও ব্যয় হচ্ছে ১৪ কোটি, আবার কোথাও ৪৮ কোটি টাকা, মানে তিন গুণ। ২০১৭ এর ডিসেম্বরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে উপস্থাপিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনেও নির্মাণ ব্যয়ে বিরাট তারতম্যের চিত্র উঠে আসে।
ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালার চর নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৮৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৪৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণ ব্যয় ১৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু খুলনা থেকে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের আরেকটি প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ধরা হলো ৪৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ব্যয়ে এতবড় ব্যবধানে হতবাক হয়েছেন সংসদীয় কমিটির কয়েক সদস্য।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর রেলপথ নির্মাণ ব্যয়ের তুলনামূলক প্রতিবেদন চেয়েছিল। কিন্তু সে তথ্য পাওয়া যায়নি। অপর দিকে মন্ত্রণালয় রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের অধীনে একটি সমাপ্ত ও চারটি চলমান প্রকল্পের ব্যয়ের চিত্র উপস্থাপন করেছে।
আরো একটি অবাক করা বিষয় রয়েছে। চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা জেলার লাকসাম এবং চিনকী আস্তনার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় আবারো বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয় দফায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একইসাথে বেড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ। পাঁচ বছরের প্রকল্প শেষ করতে লেগে যাচ্ছে ১০ বছর। এ প্রকল্পটির বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় এক হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ১২৯১.৯১ কোটি টাকা এবং জাইকা প্রকল্প সাহায্য হিসাবে ৫২৭.৬৪ কোটি টাকা দেবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক ২০১৮ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
যাত্রীসেবার মান বাড়াতে এবং রেলকে আধুনিকায়ন করতে কেনা হয়েছিল ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ট্রেন। তাতে মান বাড়েনি, আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি; বরং যাত্রীদের কাছে এক ধরনের যন্ত্রণার নাম ‘ডেমু ট্রেন’। এটি পরিচালনা করতে গিয়ে রেলের লোকসানের বোঝা বেড়েই চলেছে। ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন ইতোমধ্যেই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে ১০ সেট ট্রেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬৫৪ কোটি টাকায় ১০টি ইঞ্জিন ও উন্নতমানের ১০০টি কোচ কেনা যেত। তাতে যাত্রীসেবার মান অনেক বাড়ত। কিন্তু সরকার তা না করে করল উল্টো। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে এই ট্রেন উদ্বোধন করেন। দুই পাশে দু’টি ইঞ্জিন ও মাঝখানে বগিসহ ডেমু ট্রেন দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু এর ভেতরের অবস্থা অনেকটাই বিপরীত। আকারে ছোট হওয়ায় ট্রেনের ভেতরে খুব গরম। এর দরজাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলে এবং বন্ধ হয়। জানালাগুলো সরু হওয়ায় ভেতরে বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে না। এ কারণে ভয়াবহ তাপের সৃষ্টি হয়। গাদাগাদি করে চলতে গিয়ে যাত্রীদের অনেকেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। এই ট্রেনে কোনো বাথরুম নেই। লোকসান কমাতে মাঝে মধ্যে এই অত্যাধুনিক ট্রেন বসিয়ে রাখা হয়। চট্টগ্রামে যাত্রীদের চাপে ডেমুর স্বয়ংক্রিয় দরজা ভেঙে সার্বক্ষণিকভাবে খোলা রাখা এবং জানালা ভেঙে বড় করা হয়েছে। তারপরেও যাত্রী বাড়ানো যাচ্ছে না। কয়েক দফা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। হ
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
abutaher16@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement