২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

যে কারণে বাসযাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে

মাদারীপুরের শিবপুর উপজেলায় ঢাকাগামী একটা যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশের মাদারীপুরে মহাসড়কে একটি বাস দুর্ঘটনায় অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর আহত হয়েছে বাসটির প্রায় সব যাত্রী।

সড়ক পরিবহন নিয়ে কাজ করে, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম তিন মাসেই সারা দেশে অন্তত এক হাজার সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। যার বড় একটি অংশ হয়েছে বাস, ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানগুলোর কারণে।

সড়ক পরিবহন খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এই খাতে বেশ কয়েকটি সমস্যা বিরাজমান থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা হচ্ছে। আইন হলেও তার শক্ত প্রয়োগ না থাকায় বাস্তব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান কী বলছে?

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা দেশে ছয় হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নয় হাজার ৯৫১ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১২ হাজারের বেশি মানুষ। সেসব দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যেসব যানবাহনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তার মধ্যে বাস রয়েছে ১৪ শতাংশ, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ২৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ আর মোটরসাইকেল ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনেও অনেক ক্ষেত্রে বাস বা ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান দায়ী বলে তথ্য রয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এ বছর দু’মাসে সড়কে ১৭৮টি বাস দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত আর ৭৪৪ জন আহত হয়েছে। শুধু জানুয়ারি মাসে বাস দুর্ঘটনায় ৯৭ জন নিহত আর ৩৬৯ জন আহত হয়েছিল।

বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পেছনে বেপরোয়া বাস চালানোসহ নিচের পাঁচটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

১. বেপরোয়া বাস চালানো

মাদারীপুরে যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, অভিযোগ রয়েছে যে সেটি নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি জোরে চালানো হচ্ছিল।

বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণাতেও দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় একটি কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা। বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব- ইত্যাদিকেও দায়ী করা হয়েছে এসব দুর্ঘটনার জন্য।

বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল আলম তালুকদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ’বাস একটা গণপরিবহন হলেও এটা হয়ে গেছে প্রাইভেট পরিবহন। এটা উচিত ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা, নজরদারিতে থাকা। কিন্তু এটা ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় সবাই তাদের স্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করে।

তিনি বলেন, ‘এ কারণে মালিকরাও চেষ্টা করে, কত কম খরচ করে, পরিবহন শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে বেশি লাভ করা যায়। ফলে তারা বাসের মেইনটেন্যান্সের দিকে নজর দেয় না, শ্রমিকদের সুবিধা দেখে না। বেশি লাভ করার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মহাসড়কে এসব দুর্ঘটনা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘এসব কারণে সড়ক পরিবহন খাত জুড়ে নানারকম চক্র তৈরি হয়েছে। ফলে এখানে একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। যে যার মতো করে বাস চালাচ্ছে, সেটার কোনো তদারকি নেই, নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ কারণেই সড়ক জুড়ে দুর্ঘটনা এত বেড়ে চলেছে।’

২. চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ

হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মাদারীপুরের ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে না ঘুমিয়ে একের পর এক বাসের ট্রিপ দিয়েছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান।

ফরিদপুরের একজন বাস চালক আনোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আমরা ট্রিপ হিসাবে টাকা পাই। আমাদের তো ফিক্সড কোনো বেতন নাই, প্রতিদিন যতগুলো ট্রিপ দিতে পারব, সেই হিসাবে আমাদের ইনকাম বেশি হবে। তাই অনেকেই চেষ্টা করে একটু বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি ইনকাম করার। আর বেশি ট্রিপ দিতে হবে বলে তারা গাড়িও বেশি জোরে চালায়।’

বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো: মোজাম্মেল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন,‘বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবহনে চালকদের দিয়ে বেশি পরিশ্রম করানো হচ্ছে। আমাদের দেশে ভারী যানবাহনের চালকের ভয়ঙ্কর রকম সঙ্কট রয়েছে।

তিনি বলেন,'আবার চালকরা বেতন না পেয়ে ট্রিপ ভিত্তিক টাকা পেয়ে থাকেন। এতে করে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ভোর বেলা অনেক সময় ঝিমুনি চলে আসতে পারে। বিশেষ করে চালকের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না করে এরকম ট্রিপ ভিত্তিক করার কারণে দেশে অসংখ্য দুর্ঘটনা হয় বলে আমরা দেখতে পেয়েছি।’

৩. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন

অভিযোগ উঠেছে যে, মাদারীপুরের বাসটির ফিটনেস ছিল না। নভেম্বর মাসে এই বাসটি একবার সড়ক দুর্ঘটনায় পড়লেও সেটিই আবার যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল। দুর্ঘটনার সময় বাসের একটি টায়ার ফেটে গিয়েছিল বলে তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন।

অধ্যাপক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক আর চালক ফিটনেসের তোয়াক্কা করেন না। টাকা পয়সা দিয়েও অনেক সময় তারা ফিটনেস সার্টিফিকেট যোগাড় করে নেন বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু এই বাসটির তো তাও ছিল না।’

মো: মোজাম্মেল হক বলছেন,‘আমরা দেখেছি, এই বাসটিতে পুরনো টায়ার ব্যবহার করা হচ্ছিল, যেটা সারা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ। এটা বার্স্ট হয়ে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে অহরহ পুরনো টায়ার বিক্রি করা হয়। বাস মালিকরা বেশি মুনাফা করতে গিয়ে এসব টায়ার কিনে বাস-ট্রাক চালান, যা দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।’

তিনি বলছেন, একইসাথে বাস মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফাও এর জন্য দায়ী। মাদারীপুরের বাসটির আসন সংখ্যা ৪০ হলেও এর অনেক বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছিল। ফলে বাসটিতে হতাহতের সংখ্যাও বেশি হয়েছে।

অনেক মালিক যে ফিটনেস-বিহীন গাড়ি চালান, এই অভিযোগ মেনে নিয়ে এ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের প্রেসিডেন্ট রফিকুল ইসলাম কাজল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘অনেক অল্প পুঁজির বাস মালিক আছে। তাদের পক্ষে তো সবসময় বাস নজরদারি বা চালকদের নিয়ন্ত্রণ করা, বা যাচাই বাছাই করা সম্ভব হয় না।’

তিনি মনে করেন, পরিবহন খাতে যে বিশৃঙ্খলাই থাকুক, সেটা অভিজ্ঞ আর শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।

রফিকুল ইসলাম বলেন,‘আমি তো বলবো, ঢাকা শহরে যেসব বাস চলে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ফিটনেস নাই। এখন আমরা মালিকরা নিজেদের স্বার্থে অনেক সময় চোখ বন্ধ করে রাখি। সেটাকে তাদের স্বার্থ বলব। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তো দায়িত্ব নজরদারি করা, এদের আইনের মধ্যে নিয়ে আসা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যদি কঠোর হয়, পুলিশ যদি কঠোর হয়, তাহলে তো আর কেউ এরকম বাস চালাতে পারবে না।’

৪. নজরদারি আর তদারকির অভাব

বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পুরো সড়ক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা রয়েছে। যার সুযোগে ফিটনেস-বিহীন বাস চলছে, অদক্ষ চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কারো কোনো নজরদারি নেই।

বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো: মোজাম্মেল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘এই বাসটির ফিটনেস ছিল না, রোড পারমিট স্থগিত ছিল, তারপরেও এই যানটি কীভাবে সড়কে যাত্রী নিয়ে চলছে, সেজন্য বিআরটিএ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ এখানে সরকারের নজরদারি, কর্তৃপক্ষের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুস্পষ্ট গাফিলতি ও উদাসীনতা স্পষ্ট দায়ী।’

বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলছেন, ‘এখানে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে আইনকে কেউ ভয় পায় না, কারণ আইনের প্রয়োগ তো ঠিকমতো হয় না, কারো শাস্তি হয় না। তাই চালকরা ইচ্ছে মতো বাস চালায়, মালিকরা ফিটনেসের কেয়ার করে না, সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে থাকে।’

বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এরকম মহাসড়কে কড়া নজরদারি ও ক্যামেরা থাকা উচিত। একটি গাড়ি অতিরিক্ত গতিতে চললে সেটাকে যেন দুর্ঘটনার আগেই থামানো যায়, আইনের মধ্যে আনা যায় সেই ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। আধুনিক টেকনোলজি আনতে হবে।

৫. অদক্ষতা

এ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের প্রেসিডেন্ট রফিকুল ইসলাম কাজল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, চালকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো গুরুতর। গাড়ী চালানোয় তার মনোযোগ ছিল না। বার বার বলার পরেও তিনি বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, সমস্যা হলো আমাদের দেশে চালকের লাইসেন্সে দক্ষতা যাচাই করে দেখা হয় না। টাকা পয়সা দিয়েও অনেকের লাইসেন্স হয়ে যায়। আমি মনে করি, সরকারিভাবে ড্রাইভিং ইন্সটিটিউট করে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তাদের দক্ষতা বাড়তে পারে।’

এর আগেও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, চালকদের অনেকের সড়কের চিহ্ন এবং আইনকানুন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। এমনকি অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement