২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘রকেটের গতিতে সিনেমার মতো উড়ে গিয়ে পড়ে বাসটি’

পদ্মাসেতু এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বাসটি খাদে পড়ে যায় - ছবি : সংগৃহীত

পদ্মাসেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বাস খাদে পড়ে যাওয়ায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি আছে বেশ কয়েকজন।

এছাড়া শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা নিয়ে দু’জন বাড়ি ফিরে গেছে বলে জানিয়েছেন মেডিক্যাল অফিসার ডা: আসিফুর রহমান।

কেন এই দুর্ঘটনা?
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমাদ পরিবহনের বাসটি ভোর সাড়ে ৪টায় খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। এরপর পদ্মাসেতুর আগে শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়ন্ত্রণ হারায় সেটি। বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে নিচে খাদে পড়ে যায়। এতে এর সামনের অংশ একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হয়।

কিভাবে ঘটলো এই দুর্ঘটনা?
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, বেপরোয়া গতির কারণে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাকতে পারে।

মাদারীপুর পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণেই বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে। তবে তদন্ত করার পরই কারণটা জানা যাবে।’

ইতোমধ্যে কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে এবং দুই কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার বিভিন্ন কারণ আলোচনায় উঠে এসেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জানায়, বাসটি খুলনা থেকেই কারিগরি ত্রুটি নিয়ে রওনা দেয়। পথে ওই কারণেই ঘটেছে দুর্ঘটনা।

স্থানীয় সাংবাদিক সঞ্জয় অভিজিৎ কর্মকার ঘটনার শুরু থেকেই সেখানে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। তিনি জানান, বাসটির গতি ছিল তীব্র এবং সামনের বাম পাশের চাকা ফেটে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

রকেটের গতিতে সিনেমার মতো উড়ে গিয়ে পড়ে বাসটি
দুর্ঘটনাস্থল শিবচরের কুতুবপুরে এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন মোহাম্মদ সোহেল হোসেন। দুর্ঘটনাটি তার নজরে আসে বিকট শব্দে।

তিনি বলেন, ‘সকালে আমি রেস্টুরেন্টটা মাত্র চালু করে বসে আছি। ৭টা ১৫ থেকে ২০-এর দিকে ঠাস করে একটা টায়ার বার্স্টের শব্দ শুনি। দেখলাম আমার রেস্টুরেন্টের একটু সামনেই টায়ার বার্স্ট হলো, এরপর আঁকাবাঁকা হয়ে কিছুদূর গিয়ে রকেটের গতিতে, মানে সিনেমায় যেভাবে দেখি সেভাবে উড়ে নিচে পড়ে যায় বাসটি।’

এরপর দ্রুত ছুটে গিয়ে স্থানীদের সাথে উদ্ধার কাজে লেগে পড়েন তিনি। তবে সোহেল জানালেন, এই রাস্তায় প্রায়ই এমন গাড়ির চাকা ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, ‘এখানে দুই/তিন দিন পরপরই টায়ার বার্স্ট হয়। গত ২২/২৩ দিনে পাঁচ/সাতটা টায়ার বার্স্ট হতে আমি দেখছি। দু’দিনে আগে একটা ট্রাকের টায়ার এ রকম ফেটে যায়, পরে ওর ব্রেক ভালো ছিল জন্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।’

‘সামনের দিকে যারা ছিল তারাদেরই মৃত্যু হয়েছে’
ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক শিপলু আহমেদ বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস এ দুর্ঘটনার খবর পায় সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে, শিবচরের ফায়ার স্টেশন টিম ৭টা ৫৮ মিনিটে প্রথম দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, তারা গিয়ে দেখে রাস্তা থেকে ব্রিজের মতো রেলিং ভেঙে নিচে বাসটি পড়ে আছে।’

পদ্মাসেতু এক্সপ্রেসওয়ে যেটাকে সরকার বঙ্গবন্ধু সেতু নামকরণ করেছে, সেখানে প্রায়ই এমন দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় এত প্রাণহানি ঘটলো কেন?

শিপলু আহমেদ বলেন, ‘বাসের গতি নিশ্চয় বেশি ছিল, তাই আঘাতটা সজোরে লাগে। সামনের অংশ একদম দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সামনের দিকে যারা ছিল তারাই মারা গেছে।’

সাংবাদিক সঞ্জয় কর্মকার জানান, এক্সপ্রেসওয়েটা অনেক উঁচুতে। আর এর নিচ দিয়েই ছিল স্থানীয় মানুষ ও পরিবহন যাতায়াতের একটা আন্ডারপাস। বাসটি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু থেকে এসে সরাসরি ওই আন্ডারপাসের ঢালাই করা দেয়ালে ধাক্কা মারে। আর এ কারণেই এত প্রাণহানি।

তবে এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়া সঠিকভাবে করার ওপর জোর দিয়েছেন বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘যারা তদন্ত করবে তারা কোনোভাবেই এ সিস্টেমের সাথে জড়িত থাকবে না। তাকে থার্ডপার্টি হতে হবে। বিদেশে ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো এটি করে। গাড়ি ঠিক আছে কি-না, রাস্তা ঠিক আছে কি-না, ড্রাইভার ঠিক আছে কি-না, তারা সেগুলো দেখে। কিন্তু আমাদের এখানে তো এগুলা নেই। কেউ জবাবদিহিতার মধ্যে নেই। এর জন্য মনে করেন মালিক দায়ী আছে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) দায়ী, জেলা প্রশাসক কোনো না কোনোভাবে দায়ী, তারাই তো আবার তদন্ত কমিটিতে থাকছে।’

দুর্ঘটনার পুরো তদন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক করার কথা বলেন তিনি। একইসাথে এখানে মানসিক দিকটাও উপেক্ষিত থাকে বলে মনে করেন ড. তালুকদার।

তিনি বলেন, ‘এখানে সাইকোলজিক্যাল প্রেশার থাকতে পারে, ড্রাইভারের মানসিকভাবে কোনো কিছু ছিল কি-না।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের করা শিবচরের এই দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বুয়েটের এক অধ্যাপক ও বিআরটিএর এক কর্মকর্তা।

পদ্মা সেতু চালু হবার পর এক্সপ্রেসওয়েতে এটিই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা বলছে স্থানীয়রা। নিহত ১৯ জনের দাফনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement