আত্মবিশ্বাসের অভাবে অল্পতেই আত্মহত্যায় বাংলাদেশী কম বয়সীরা

এক বছরে বাংলাদেশে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে স্কুল পর্যায়ে ৩৪০ জন, কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮৬ জন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মবিশ্বাসের অভাবকে দায়ী করছেন আত্মহত্যার ঘটনাগুলোতে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা বাড়ল কেন?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনকার শিশু-কিশোরদের সকল আবদার সহজেই পূরণ করছেন অভিভাবকরা। খেলাধুলা করার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে তারা স্বনির্ভর হচ্ছে না, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাচ্ছে না। একটু না পাওয়াতেই ঝুঁকছে আত্মহত্যায়।

’স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : সমাধান কোন পথে?’-শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন শুক্রবার তাদের গবেষণাপত্র তুলে ধরে। গবেষণায় বলা হয়, ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩৭ জন স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। গত বছর এপ্রিলে সর্বোচ্চ ৫০ জন আত্মহত্যা করেন। আর সর্বনিম্ন ২১ জন আত্মঘাতী হয়েছেন আগস্টে। এছাড়া জানুয়ারিতে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৯ জন, মার্চে ৪১ জন, মে মাসে ৪৫ জন, জুনে ৩১ জন, জুলাইয়ে ৪০ জন, সেপ্টেম্বরে ৩২ জন, অক্টোবরে ৩০ জন, নভেম্বরে ৪৯ জন এবং ডিসেম্বর মাসে ৩৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ২৮৫ জন এবং ছাত্র ১৬১ জন। এর মধ্যে ৫৪ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস বলেন, ২০২২ সালের এ জরিপে দেখা যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা অনেক বেশি। তারা যে বয়ঃসন্ধিকালের সময়টি পার করছে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন ও সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কী কারণে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের পারিবারিক বন্ধন, ব্যক্তিগত চাহিদা, সামাজিক অবস্থান এসব বিষয় জানা প্রয়োজন।

প্রধান কারণ অভিমান
সমীক্ষা অনুযায়ী, আত্মহননের বড় কারণ অভিমান। আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীরা জীবদ্দশায় নানা জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নিয়েছে মান-অভিমান থেকে। ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন অভিমানে। তাদের বড় অংশেরই অভিমান পরিবারের সাথে। এছাড়া প্রেমের কারণ আত্মহত্যা ছিল ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকি কারণগুলোর মধ্যে পারিবারিক কলহে তিন দশমিক ১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ততা থেকে দুই শতাংশ, মানসিক সমস্যার কারণে এক দশমিক আট শতাংশ, আর্থিক সমস্যার কারণে আর্থিক দশমিক আট শতাংশ, উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে গেছে তিন দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এছাড়া আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, শিক্ষকের হাতে অপমানিত হওয়া, গেম খেলতে বাধা দেয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলেও সমীক্ষায় জানা গেছে৷

হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কারণ
মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, যখন শিক্ষার্থীরা হতাশাগ্রস্ত হয়, বিষন্নতায় ভোগে, যারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না, তারাই বেশি আত্মহত্যা করে। জটিল পরিস্থিতি কঠিন পরিস্থিতি, চাপযুক্ত পরিস্থিতি তারা যদি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তখন আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়। প্রেমে বিচ্ছেদ তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে না পারা, ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারা, শিক্ষার্থীর কাছে দু’টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তার মতে অল্প বয়সীরা সহজেই প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। তখন মা-বাবা সন্তানকে ঘরে বন্দি করে ফেলেন, মোবাইল ফোন কেড়ে নেন, ওয়াইফাই সংযোগ বন্ধ করে দেন। অনেকসময় স্কুল-কলেজেও যেতে দেন না, যা তাদের উপর মানসিক চাপ ফেলে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম বলেন, আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা তাদের জীবদ্দশায় নানাবিধ বিষয়ের সম্মুখীন হন, যা মোকাবিলা করতে না পারায় তারা আত্মহননের পথে ধাবিত হয়৷ এছাড়াও অন্যান্য কারনের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়া, পড়াশোনার চাপ অনুভব করা এবং পারিবারিক চাপে আত্মহত্যা।

সমাধানের পথ কী, জানতে চাইলে ডা. মোহিত কামাল বলেন, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সঠিকভাবে ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে বিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। এতে পারিবারিক বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে সন্তানদের এমনভাবে বড় করতে হবে যাতে তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে এবং নিজেদের কাজ নিজেরাই করে।

যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার আশা জাগাচ্ছে। এর একটি হলো, মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘মানসিক স্বাস্থ্য-সেবাবিষয়ক ফাস্ট এইড (পার্ট-১)’ নামে একটা অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২-এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, শিশু কিশোরদের মন সাধারণত ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয়গুলোও তাদেরকে আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সাথে অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিও তাদেরকে আত্মহত্যার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষক এবং মা বাবাদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুকালে বাচ্চাদের উপর মা বাবার প্রভাব যেমন বেশি থাকে, কৈশোরে সেই দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষদের উপর। তাই শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বেশি। সন্তানদের মানসিক বিষয়গুলো নিয়ে মা বাবারা অনেক ক্ষেত্রেই থাকেন উদাসীন। তাই সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি তত গুরুত্ব দিতে চান না, এটা ঠিক নয়।

আঁচল ফাউন্ডেশন তাদের সুপারিশে হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয় নিশ্চিত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাদের মতে স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সঙ্কটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে