২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা : মোটরসাইকেল কতটা দায়ী

সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা : মোটরসাইকেল কতটা দায়ী - ফাইল ছবি

মোটরসাইকেলে যারা চলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে হেলমেট না পরা বা আইন না মানার অভিযোগ রয়েছে, যা হতাহতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের পদ্মা সেতুতে প্রথমদিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুর পর সেতুতে এই বাহনটির চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মোটরসাইকেল-চালকদের সেতু পারাপার করার নানা কৌশল নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই চলছে আলোচনা।

কর্মকর্তাদের দাবি, মোটরসাইকেল-চালকদের বিশৃঙ্খলা তৈরি এবং বেপরোয়া চলাচল এড়াতে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বুধবার সকালেও ঢাকা ও রাজবাড়ীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে দুইজন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।

আর বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে।

এর পেছনে অবৈধভাবে লাইসেন্স পাওয়া, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চালানো আর ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজবাড়ীর একটি কলেজের ছাত্র লিমনের (ছদ্মনাম) দাবির মুখে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগেই পরিবার মোটরসাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হয়। না হলে সে স্কুলে পরীক্ষা না দেয়ার হুমকি দিয়েছিল।

কিন্তু পরীক্ষার মাত্র দুইদিন আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার পা ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত তার আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি।

গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ঈদুল ফিতরের সময় শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে মোটরসাইকেল-চালকদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।

বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ২১৪ জনের।

২০২০ সালের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশির ভাগের বয়স ৩০ বছরের নিচে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয় এমন ১৬টি দেশের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘দেশে মোটরসাইকেলের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কম টাকায় মোটরসাইকেল কিনতে পাওয়া যায়, লোনে ও কিস্তিতে পাওয়া যায়। মানুষ সামান্য টাকা হলেই এটা কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে, সেটা কেউ চিন্তা করছে না।’

অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, এদের বেশিরভাগই কিশোর-তরুণ। তারা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালায়, হেলমেট পরে না, রাস্তার কোনো আইন মানে না। ফলে এরা নিজেরাও দুর্ঘটনায় পড়ে, অন্য যানবাহনের জন্যও বিপদ তৈরি করে।

পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের মতো তালুকদারও মনে করছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনার পেছনে মোটরসাইকেল চালকদের বড় দায় রয়েছে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করছে মহাসড়কগুলোয় মোটরসাইকেল চালানো। অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার না করেই অনেকে মোটরসাইকেল চালান।

ঈদুল ফিতরের সময় মহাসড়কগুলোতে মোটরসাইকেল বেড়ে গিয়েছিল।

সেই সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।

ফলে ১৯ জুন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে ডিভিশনের একটি আলোচনায় ঈদুল আযহার সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা নিয়ে কথা হয়।

অধ্যাপক তালুকদার বলেন, ‘মোটরসাইকেল একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন, এটা হাইওয়েতে চালানোর মতো গাড়ি না। সেখানে বিশেষ লেন থাকলে চালানো যেত, কিন্তু বাস-ট্রাকের পাশাপাশি হাইওয়েতে মোটরসাইকেল চলা উচিত নয়।’

অভিযোগ রয়েছে, মোটরসাইকেল-চালকদের বড় একটি অংশের লাইসেন্স নেই। যাদের রয়েছে, তাদের অনেকে সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়াই লাইসেন্স পেয়েছেন।

বিআরটিএ-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। কিন্তু মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স রয়েছে ২৩ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মোটরসাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।

তবে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ১৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল রয়েছে যেগুলোর নিবন্ধন নেই।

বরগুনার এ রকম একজন মোটরসাইকেলচালক বলেন, ‘তিনি ভাড়ায় গাড়ি চালান। প্রতি মাসে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে ৩০০ টাকা দেন। ফলে ওই এলাকার পুলিশ তার গাড়ি ধরে না।’

নিয়ম অনুযায়ী, যথাযথভাবে আবেদনের পর নির্দিষ্ট দিনে সশরীরে পরীক্ষা দিয়ে ও গাড়ি চালিয়ে দেখিয়ে লাইসেন্স পেতে হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ঘিরে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার রাতারাতি অনেক বেড়েছে, যদিও সেইসাথে বাড়েনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা।

ঢাকার একজন মোটরসাইকেলচালক বলেছেন, ‘তিনি আট হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স করেছেন। কিন্তু তার এমনি পরীক্ষা দিতেও যেতে হয়নি। শুধু একদিন গিয়ে কয়েকটি স্বাক্ষর করতে হয়েছে। তাতেই তিনি লাইসেন্স পেয়ে গেছেন।’

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের যে পরীক্ষা নিয়ে থাকে, সেখানে চালকের দক্ষতার বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই করা হয় না।

অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলছেন, ‘অনেকে লাইসেন্সের তোয়াক্কাই করে না। কারণ লাইসেন্স না থাকার পরেও তার তেমন সমস্যা হয় না, না হলে টাকা পয়সা দিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে। আবার লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়াতেও যে সমস্যা আছে, সেটাও তো আমরা জানি।’

তবে লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় অনিয়ম নিয়ে দায় নিতে রাজি নয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ।

বিআরটিএ মুখপাত্র মাহবুব-ই-রব্বানি বলেন, যদিও লাইসেন্স আমাদের মাধ্যমে যাচ্ছে, কিন্তু এই লাইসেন্সের পরীক্ষা আমরা নিই না। আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি, বোর্ড গঠন করেছে। জেলা প্রশাসন, পুলিশ, চিকিৎসক ও রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হয়। বিআরটিএ শুধুমাত্র লাইসেন্সটা দেয়। এর বাইরে আমাদের পক্ষ থেকে আর কী করার আছে?

বিআরটিএ বলছে, আইনে বাধা না থাকলেও মহাসড়ক বা দূরপাল্লার জন্য মোটরসাইকেল অনিরাপদ একটি বাহন। নিরাপত্তার দিক চিন্তা করে চালকদের নিজেদেরই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।

বিআরটিএ রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই-রব্বানি বলছেন, মোটরসাইকেল তো একটা বৈধ বাহন, তবে এটা তো ঠিক যে, মোটরসাইকেল অন্য গাড়ির তুলনায় অনিরাপদ বাহন। নিজস্ব প্রয়োজনে স্বল্প দূরত্বের এটা ব্যবহার করার কথা। কিন্তু সেটার মিসইউজ করা হচ্ছে। লং ডিসট্যান্সে যাচ্ছে। লং ডিসট্যান্সে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল তো না। রাইডাররা নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছে।

আর পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ঢাকা এবং সারাদেশেই অবৈধ মোটরসাইকেল, লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে পুলিশ নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়ে আসছে। প্রতিদিনই এরকম চালকদের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়, মোটরসাইকেল আটক করা হয়। সুতরাং এখানে পুলিশের দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ সঠিক নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত না হলে এ রকম দুর্ঘটনা বন্ধ করা কঠিন।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে না দেয়া, সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর লাইসেন্স দেয়া, প্রয়োজন যাচাই করে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেয়া - নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এখন তো বরং মোটরসাইকেল সবার জন্য সহজলভ্য করে তোলা হয়েছে। সেখানে পরিবর্তন আনা না গেলে এভাবে বিশৃঙ্খলা, মৃত্যু, হতাহত হওয়া বন্ধ হবে না।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement