১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কী আছে এজহারে?

মোসারাত জাহান মুনিয়া - ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া (২২) নামে এক তরুণীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গত সোমবার সন্ধ্যার পর গুলশান-২-এর ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় নিহতের বোন নুসরাত জাহান বাদি হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেছেন। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, মুনিয়া আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পর গতকাল মঙ্গলবার আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।

ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে গত সোমবার গভীর রাতে নিহতের বোন নুসরাত জাহান বাদি হয়ে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ২৭, ধারা ৩০৬। মামলা ও নিহতের পরিবারের বরাত দিয়ে ডিএমপির গুলশান জোনের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, মুনিয়ার সাথে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের দুই বছর ধরে সম্পর্ক ছিল। প্রথম এক বছর মেয়েটিকে তিনি বনানীর একটি ফ্ল্যাটে রাখেন। পরে তাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলে মুনিয়া গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় চলে যায়। তবে গত মার্চে পুনরায় ঢাকায় এসে গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেন।

ডিসি আরো বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি সুদীপ বলেন, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ওই ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া এক লাখ টাকা। অগ্রিম দেয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। এরই মধ্যে দুই মাসের ভাড়াও পরিশোধও করা হয়েছে।

এ দিকে নিহত মুনিয়ার পরিবারের অভিযোগ, এটি আত্মহত্যা নয়, মুনিয়াকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিহতের বোনের স্বামী মিজানুর রহমান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, মুনিয়ার পরিবারের সদস্যরা কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। ঢাকার একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মুনিয়া লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকতেন। তাকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। গত শুক্রবার মুনিয়ার বাসায় ইফতার পার্টি হয়। এ সময় তোলা কিছু ছবি মুনিয়া ফেসবুকে আপলোড করে। এটা নিয়ে আনভীর তাকে গালিগালাজ করে।

নিহত মেয়েটির বাবার নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার কোতোয়ালি। থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বাদি বলেছেন, মোসারাত জাহান (২১) মিরপুর ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। দুই বছর আগে মামলার আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের (৪২) সাথে মোসারাতের পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে তারা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখা করতেন এবং সব সময় মোবাইলে কথা বলতেন। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এজাহারে বলা হয়, ২০১৯ সালে মোসারাতকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আসামি রাজধানীর বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সেখানে তারা বসবাস করতে শুরু করেন। ২০২০ সালে আসামির পরিবার এক নারীর মাধ্যমে এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারে। এরপর আসামির মা মোসারাতকে ডেকে ভয়ভীতি দেখান এবং তাকে ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আসামি কৌশলে তার (বাদি নুসরাতের) বোনকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন।

এজাহারে আরো বলা হয়, সবশেষ গত ১ মার্চ মোসারাতকে প্ররোচিত করেন আসামি। তিনি বাসা ভাড়া নিতে বাদি নুসরাত ও তার স্বামীর পরিচয়পত্র নেন। ফুসলিয়ে তিনি মোসারাতকে ঢাকায় আনেন। তিনি গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে বাসা (ফ্ল্যাট-বি-৩) ভাড়া নেন। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি ও তার (বাদির) বোনের স্বামী-স্ত্রীর মতো ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখা হয়। আসামি বাসায় এলে কক্ষটি পরিপাটি করে রাখা হতো।

বাদি নুসরাত এজাহারে বলেন, বোনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তাকে বিয়ে করে বিদেশে স্থায়ী হবেন। কারণ দেশে থাকলে আসামির মা-বাবা আসামিকে কিছু না করলেও তার বোনকে মেরে ফেলবেন। গত ১ মার্চ থেকে আসামি মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন।

বাদি এজাহারে বলেন, ২৩ এপ্রিল মোসারাত তাকে ফোন করে বলেন, আনভীর তাকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, কেন তিনি (মোসারাত) ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রীর বান্ধবী পিয়াসা দেখেছেন। তিনি তার (আসামির) মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন।
এজাহারে বলা হয়, আসামি মোসারাতকে বলে, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাকে (মোসারাত) মেরে ফেলবেন।

এজাহারে নুসরাত বলেন, দু’দিন পর ২৫ এপ্রিল মোসারাত তাকে ফোন করেন। ওই সময় তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন। আসামিকে উদ্ধৃত করে মোসারাত বলেন, আসামি তাকে বলেছেন, তিনি (মোসারাত) তার শত্রুর সাথে দেখা করেছেন। মোসারাতকে তিনি ছাড়বেন না। মোসারাত চিৎকার করে বলেন, আসামি তাকে ধোঁকা দিয়েছেন। যেকোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদি নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।

এজাহারে আরো বলা হয়, নুসরাত তার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বেলা ২টার দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওনা দেন। আসার পথে বারবার মোসারাতের ফোনে ফোন করেন, কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলশানের বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিচে নেমে আসেন। তারা নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করেন। পরে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন দিলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার পরামর্শ দেন। মিস্ত্রি ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তার বোন ওড়না পেঁচিয়ে শোয়ার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আছেন।

এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, পুলিশ এসে ওড়না কেটে মোসারাতের লাশ নামায়। আলামত হিসেবে আসামির সাথে ছবি, আসামির সাথে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ডায়েরি ও তার ব্যবহৃত দু’টি মুঠোফোন নিয়ে যায় পুলিশ।

এ দিকে এই ঘটনার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ফোনকল রেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে ৫০ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে মেয়েটিকে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করছে একজন পুরুষ। অপর দিকে মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, ‘আমি কোনো টাকা নিইনি। আপনি কেন আমাকে মিথ্যা ব্লেম দিচ্ছেন, আল্লাহ তো বিচার করছে কালকে আপনাকে, তারপরও আমার পেছনে লাগছেন তাই না, এখন আর কোনো অপশন পাচ্ছেন না, আমারে বাঁশ দেয়ার জন্য এইটা বের করছেন’। অপর প্রান্ত থেকে পুরুষ বলছে, ‘চুপ (গালি দিয়ে) তুই একটা চোর। তুই আমার টাকা দিবি, না হলে তোর বাসায় পুলিশ যাবে। তখনো কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেয়েটি বলছিল, ‘ঠিক আছে আপনি পুলিশ নিয়ে আসেন।’ কিন্তু টাকাটা কিভাবে মেয়েটি নিয়েছে সে ব্যাপারে কোনো কথা শোনা যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement