১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গুলিতে বিদ্ধ ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন ওদের

গুলিতে বিদ্ধ ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন ওদের - ছবি : সংগৃহীত

পেটের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি গুলির চিহ্ন, পিঠে মারধরের আঘাতের চিহ্ন, হাতে ও পায়ে গুলিসহ আঘাতের চিহ্ন নিয়ে দেশে ফেরেন ভৈরবের জানু মিয়া। ঘটনার চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন জানু মিয়া। ভালো করে এখনো হাঁটতে পারছেন না। শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তারপরও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে তিনি বলেন, জানে বেঁচে এসেছি এটাই অনেক। শুধু জানু মিয়াই নয়; তার মতো শরীরের বিভিন্ন সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছেন ফেরত আসা বাকি আটজনও। তারা হলেন- সজল, বকুল, সাইদুল, কিরণ, সোহাগ, মো: আলী, তরিকুল ও ওমর। এদের কারো পায়ে গুলির দাগ, কারো হাতে, কারো হাতে-পায়ে ও পেটে। এ ছাড়া মারধরের মতো নির্যাতনের আঘাতের চিহ্ন তো রয়েছেই। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় গেলেও দুর্বৃত্তদের গুলিতে ওদের স্বপ্ন পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে। 

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে মানবপাচারকারীরা বর্বরোচিতভাবে ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যা করে। এ সময় ১২ জন আহত হয়। এ ঘটনায় দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। মানবপাচারকারীর গুলিতে মোট ৩৮ বাংলাদেশী গুরুতর আহত হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ১২ জন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও নির্যাতিত ৯ ভিকটিমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল তাদের সিআইডি সদর দফতরে হাজির করা হয়। সেখানে ঘটে যাওয়া ২৮ মে’র সেই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন তারা।

ভৈরবের জানু মিয়া বলেন, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ভারত যান। ভারত থেকে দুবাই, দুবাই থেকে মিসর এবং সেখান থেকে লিবিয়ায় যান। প্রথমে তাকে লিবিয়ার বেনগাজিতে রাখা হয়। সেখানে অনেক বাঙালির দেখা পান জানু মিয়া। আর পুরো পথ পাচারকারী চক্রের মধ্যেই ছিলেন। তবে জানুয়ারি মাসে বেনগাজিতে তিনি কাজ পেলেও সেখানে থাকা-খাওয়াসহ ছিল হাজারো সমস্যা। এ দিকে লিবিয়ার ত্রিপলি যেতে পারলে উন্নত জীবনযাপন সম্ভবÑ এমন স্বপ্ন দেখায় সেখানে অবস্থান করা বাংলাদেশী দালাল তানজিরুল। একবার আশাহত হয়েও ফের আশায় বুক বাঁধেন জানু মিয়া। তাই পরিবারকে বলেন বাংলাদেশী দালালকে ফের টাকা দিতে। সেখানেও জনপ্রতি নেয়া হয় চার-পাঁচ হাজার করে ডলার। পরে জানু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বাঙালিকে একত্রিত করে ত্রিপলি নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দালাল তানজিরুল। ভিকটিমরা উন্নত জীবনের আশায় ত্রিপলি যেতে চাইলেও মনে ব্যাপক ভয়ও কাজ করছিল। কেননা, দীর্ঘ যাত্রাপথ মরুভূমিতে অপহরণসহ নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী ডলার দিলে এসবের কিছুই হবে না বলে আশ্বস্ত করে বাংলাদেশী দালাল তানজিরুল। 

জানু মিয়া বলেন, বেশ কয়েকজন বাঙালি আফ্রিকান ত্রিপলির উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু তাদেরকে প্রচলিত ও ব্যবহৃত পথে না নিয়ে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বেশ বিপদসঙ্কুল একটি পথে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বেনগাজি থেকে মরুভূমির রাস্তায় যুওয়ারা যাওয়ার পথে তারা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। ৩৮ বাংলাদেশীসহ বেশ কয়েকজন সুদানি নাগরিককে অপহরণের পর অপহরণকারী চক্র অন্য দালাল চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ওই দালাল চক্র ত্রিপলি থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে মিজদা শহরে ১৫ দিন তাদের আটকে রাখে। অপহরণকারীদের সাথে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি চলছিল। অনেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেও কাক্সিক্ষত মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে অপহরণকারীরা। এতে সুদানি নাগরিকরা বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহে অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে মেরে ফেলে বাংলাদেশীদের সাথে থাকা সুদানি নাগরিকরা। এরপর নিহত দালালের পরিবারের সদস্যরা ওই ভবনটি ঘেরাও করে এবং লাশ ফিরে পাওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করে। একপর্যায়ে ওই ভবনে উপস্থিত ১০০ জন অভিবাসী আত্মসমর্পণ করেন; কিন্তু ৪০ জন ভবন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ২৮ মে নিহত দালালের পরিবার ভবনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও রকেট দিয়ে হামলা করে। এতে ৩৮ জন বাংলাদেশীর সবাই গুলিবিদ্ধ হন। মারা যান ২৬ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় কয়েকজন ভেতরেই পড়ে ছিলেন, দুই-একজন আহত অবস্থায় বের হয়ে আসেন।

জানু মিয়া জানান, একটি কক্ষে তাদের আটকে রেখে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এতে ২৬ বাঙালি, চার আফ্রিকান নিহত হন। শরীরে একাধিক গুলি লাগার পরও তারা অনেকেই লাশের মধ্যে চুপ করে শুয়ে ছিলেন। এভাবেই অনেকে বেঁচে গেছেন। অনেকের লাশ মরুভূমিতে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা। জীবিত অনেককে মৃত ভেবে মরুভূমিতে ফেলে রাখা হয়। তাকেও মরুভূমিতে ফেলে রেখে যায়। পরে একজন সুদানি তাকেসহ বেশ কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে সেখানকার সেনাবাহিনীকে খবর দেয়। সেনাবাহিনী এসে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরে সিআইডি তাদের নয়জনকে একত্রে ফিরিয়ে আনে। 

ঘটনার চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন জানু মিয়া। ভালো করে এখনো হাঁটতে পারছেন না। শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তারপরও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে তিনি বলেন, জানে বেঁচে আসছি এটাই অনেক। জানু মিয়ার মতো শরীরের বিভিন্ন সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছেন ফেরত আসা বাকি আটজনও। এদের কারো পায়ে গুলির দাগ, কারো হাতে, কারো হাতে-পায়ে ও পেটে। এ ছাড়া মারধরের মতো নির্যাতনের আঘাতের চিহ্ন তো রয়েছেই।
সে দিনের ঘটনা তুলে ধরে সাইদুল বলেন, তার শরীরে পাঁচ-ছয়টি গুলি লাগে। শারীরিক ও মানসিক ক্ষতের কারণে স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে গেছে তার। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর থেকেই সেখানকার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন তারা। তারপর কয়েক দফা বিক্রি করা হয় তাদের। নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন তারা।
ভিকটিম সজল বলেন, আমি ওই রাত থেকে আর ঘুমাতে পারি না। ঘুমাতে গেলে গুলির আওয়াজ কানে আসে। ঘুমাতে কষ্ট হয়। আমাদের মারধর করে। আফ্রিকার আরেকজন পিটিয়ে মেরে ফেলে রেখে আমাদের দেখিয়ে বলে, যদি টাকা না দিস তবে তোদের এই অবস্থা হবে। ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে দেশের মায়া ত্যাগ করে এভাবে বিদেশে গিয়ে জানে ফিরে আসা সবার গল্প একই সূত্রে গাঁথা। তারা বলছেন, না খেয়ে থাকলেও দেশে থাকবেন, কোনো দালালের মাধ্যমে বিদেশে আর যাবেন না। 
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি আবদুল্লাহ হেল বাকী বলেন, চলতি বছরের গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে মানবপাচারকারীদের দ্বারা বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ২৬ বাংলাদেশী নিহত ও ১২ জন আহত হন। এ ঘটনায় মোট ২৬টি মামলা করা হয়, যার মধ্যে সিআইডি ১৫টি মামলার তদন্ত করছে। এর মধ্যে ৪৪ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার তদন্তকালে অনেক আসামিই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। লিবিয়ায় অবস্থানরত মানবপাচারের সাথে জড়িত ১০-১২ দালালকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট জারি করা হবে। তিনি বলেন, বর্বরোচিত ঘটনার পর সিআইডি আহত ভিকটিমদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করে। যার ফলে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বাংলাদেশ ও লিবিয়ার যৌথ উদ্যোগে বোরাক এয়ারের বিশেষ ফ্লাইট ভিজেড ২১৮ যোগে হজরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন তারা। আহত ১২ ভিকটিমের মধ্যে বাপ্পী দত্ত, সম্রাট খালাসী এবং সাজিদকে আনা সম্ভব হয়নি। আহত ওই ভিকটিমকেও ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।


আরো সংবাদ



premium cement