২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘গলা কাটা’ আতঙ্ক জেঁকে বসেছে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে

- ছবি : সংগৃহীত

দেশের অন্যতম বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন একটি গুজব যে দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে কতটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে, তার একটি প্রমান পেলাম বরগুনা শহরে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহর বরগুনায় গিয়েছিলাম পেশাগত কাজে চলতি সপ্তাহে, আর একদিন শহরের কেন্দ্রে একটি কোচিং সেন্টারে যাই বিকেল পাঁচটা নাগাদ।

বড় গেট পেরিয়ে কোচিং সেন্টার চত্বরে ঢুকতেই বেশ কিছু নারী-পুরুষ আমাকে দেখে সতর্ক হয়ে উঠলেন। অনেকটা মারমুখী ভঙ্গিতেই দুজন পুরুষ এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। আমি নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পরও তারা ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না।

আমার সাথে থাকা বরগুনার স্থানীয় একজন সাংবাদিকের আত্মীয় ওই কোচিং সেন্টারের অন্যতম শিক্ষক। তিনি আসার পর অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ওই শিক্ষক পরে আমাকে বললেন, অভিভাবকদের কয়েকজন প্রথমে আমাকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করেছিলেন।

বেশ কয়েকদিন ধরেই সারা বাংলাদেশে গুজব ছড়িছে পড়েছে যে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন। আর সে গুজব থেকেই অভিভাবকের মনে এই প্রবল সন্দেহ বলে জানালেন ওই শিক্ষক।

পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ অবশ্য সপ্তাহ দু'এক আগে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করেই জানিয়েছে যে "একটি কুচক্রী মহল" সেতুতে মাথা লাগার গুজব ছড়িয়েছে। এই গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্যও কর্তৃপক্ষ সবার প্রতি আহবান জানায়।

এছাড়া, গুজব ঠেকাতে বিশেষ অভিযানের কথা জানিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

তবে এসব পদক্ষেপ নেয়ার পরও যে পুরস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটেনি, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ছেলেধরা সন্দেহে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনায়।

বরগুনার কোচিং সেন্টারে আমার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলেধরা নিয়ে তাদের সন্দেহ আর চলমান গুজব নিয়ে অভিভাবকেরা বেশ খোলামেলা ভাবে তাদের মনোভাব প্রকাশ করলেন।

জেসমিন আক্তার নামে এক অভিভাবকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তাদের এই সন্দেহ?

"টেলিভিশনে দেখলাম, নেত্রকোনা বলে একটা জায়গা আছে, ওখানে একটা লোকের ব্যাগের ভিতরে বাচ্চার মাথা পাওয়া গেছে। লোকটাকে পিটাইয়া ওখানেই মাইর‍্যা ফালাইছে। এসব দেইখা আমাদের ভয় হয়। বাচ্চাদের একা ছাড়তে পারি না," বলছিলেন জেসিমন আক্তার।

'কাটা মাথা' আতঙ্ক এখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। নিজের শিশু সন্তান হারিয়ে যাওয়ার ভয় এখন মানুষের মধ্যে জেঁকে বসেছে। কোন কিছুতেই তারা বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না যে এটা একেবারেই একটা গুজব।

নেত্রকোনায় এক ব্যক্তির ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা পাওয়া গেছে, এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মূলত এই ধারণা মানুষের মাঝে অনেকটা বদ্ধমূল হয়েছে যে 'কাটা মাথার' বিষয়টি কোন গুজব নয়।

কেন এটা বিশ্বাস করছেন? - জেসমিন আক্তারকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "টেলিভিশনের খবর সবাই বিশ্বাস করে। ওখানে সত্যিটাই দেখানো হয় বা বলা হয়।" কিন্তু এই আতঙ্ক কি কেবল শুধু শহর-কেন্দ্রীক?

প্রত্যন্ত গ্রামের অবস্থা
বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বরগুনা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দুরে নলিবাজার নামের একটি এলাকায় গেলাম। এ জায়গাটি জেলে অধ্যুষিত এলাকা। অনেকটা অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম যে সেখানে 'কাটা মাথা' গুজব বরং আরো জোরালো। এলাকায় অপরিচিত মানুষ দেখলেই সন্দেহ করছেন সবাই।

আমি যখন সেখানে বাজারে পৌঁছলাম, দেখলাম লোকজন বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এক ব্যক্তি এসে সরাসরি আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। আমি পরিচয় দিলাম, আর আমার সাথে থাকা স্থানীয় ট্রলার মালিক সমিতির এক ব্যক্তি আমার পরিচয় তাদের কাছে নিশ্চিত করলেন।

জানলাম 'কাটা মাথা' গুজব গ্রামাঞ্চলে এতোটাই ছড়িয়েছে যে বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি পর্যন্ত কমে গেছে।

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মারজানা রহমান বললেন, "এইডা তো এখন সব জায়গায় ছড়াছড়ি চলে যে কল্লা কাডা, বাচ্চারা একটু ভয় পায় আসতে চায় না। এ রকম একটা প্রভাব পড়া স্বাভাবিক, সব জায়গায়।"

সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো, এমন গুজবও ছড়িয়েছে যে প্রতিটি স্কুল থেকে একটি করে শিশু চাওয়া হয়েছে।

মারজানা রহমান বলেন, "অনেকে জিজ্ঞেস করে যে আপনার স্কুলে কি এ রকম কোন তথ্য দিছে যে একটা বাচ্চা দেয়া লাগবে? আমরা বলি যে এ ধরণের কোন তথ্য নাই। এটা সম্পূর্ণই গুজব।"

কিন্তু শিক্ষকদের কথাও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না অভিভাবকেরা। মারজানা রহমান বলেন, "আসলে এতোই ছড়াছড়ি চলতেছে যে এইডা বললেও সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। তারা বলে, সব জায়গায় কি এতো মিথ্যা কথা হয়?"

অভাবনীয় বিষয় হচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন অনেক অভিভাবক শিশু সন্তানদের স্কুলে আনা-নেয়া করছেন।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মোল্লা নামে এক অভিভাবক বলেন, "এখন বাচ্চাদের সাথে যাওয়া লাগে এবং বাচ্চাদের স্কুল থেকে যাইয়্যা আনা লাগে। আমরা খুব আতঙ্কের ভিতরে আছি।"

গুজব কিভাবে ছড়িয়েছে
আমি যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের কেউ-ই ফেসবুক ব্যবহার করেন না বলে দাবি করেছেন। পুরুষেরা বলেছেন, গ্রামের হাট-বাজারে অনেকেই 'কাটা মাথা' প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন, আর সেখান থেকেই তারা এটি শুনেছেন।

অনেকে আবার লোকমুখে শুনেছেন যে দূরের কোন গ্রামে এক শিশু হারিয়ে গেছে। যদিও বিষয়টি তারা কখনো যাচাই করেননি, তবে এভাবেই গুজবের ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে। নলিবাজার এলাকার বাসিন্দা মোঃ দুলাল মিয়া জানালেন, তিনি এলাকার সবার কাছে একই কথা শুনছেন। "বাজারে শুনছি, ফেসবুকে-টুকে না। খালি মানুষের মুহে-মুহে"।

অন্যদিকে নারীদের অনেকেই বিষয়টি শুনেছেন হয়তো তাদের আত্নীয়-স্বজনের কাছে, নয়তো স্কুলের অন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে।

"এইটা মানুষের মুখে-মুখে। যেমন স্কুলে আসছি, এক ভাবী বললো, এ রকম ছেলে ধরা বের হইছে। এ রকম কইরা শুনছি," বলছিলেন অভিভাবক জেসমিন আক্তার।

সরকারের তরফ থেকে অবশ্য এখন তথ্য জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে পদ্মাসেতুতে মাথা লাগার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবে গত এক সপ্তাহে ছেলেধরা আতঙ্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনিতে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, "মানুষ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় সেজন্য জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিভিসিসহ নানা ভাবে প্রচারণা চালানো শুরু হয়েছে এবং আরো ব্যাপকতর করা হচ্ছে।"

ব্যাপক হারে প্রচারণার জন্য আগামী ৩১ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এক সাথে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে বলেও জানান তিনি। বিবিসি বাংলা।


আরো সংবাদ



premium cement