২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক : সমরকন্দের তিলইয়া-কুরি মাদরাসা

ঐতিহাসিক তিলইয়া-কুরি মাদরাসা। - ছবি : সংগৃহীত

সমরকন্দ উজবেকিস্তানের প্রাদেশিক জনপদ শহর। আব্বাসী ও সামানিদের শাসনামল ছিল তার স্বর্ণালি যুগ। অনুরূপ তৈমুর লংয়ের যুগেও (১৩৬৯-১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দ) শহরটির বেশ প্রতিপত্তি ছিল। তিনিই এটিকে তার শাসনাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী বানান। তৈমুর লংয়ের পরবর্তী শাসকদের সময়েও সমরকন্দের সেই জৌলুস অবশিষ্ট ছিল এবং এটি বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে রূপান্তরিত হয়। বিশেষত তার পৌত্র উলুগ বেগ (১৩৯৪-১৪৪৯)-এর শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমরকন্দের এক অনন্য অধ্যায় সূচিত হয়। নতুন নতুন শিক্ষালয়, মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল, বাজার-ঘাটের গোড়াপত্তন হয়। সমরকন্দ হয়ে ওঠে আলোকিত এক নগরী। এখানে অনেক মহান মুসলিম মনীষী জন্মগ্রহণ করেছেন এবং বহু বিখ্যাতদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে এ অঞ্চলের মাটি।

সমরকন্দে আজও সেসব কীর্তিমান মুসলিম মনীষী এবং ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির বহু প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকের পরে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বেশকিছু ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে উলুগ বেগ মাদরাসা, তিলইয়া-কুরি মাদরাসা, এবং শের-দুর মাদরাসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে (১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দ) নির্মিত তিলইয়া-কুরি মাদরাসাকে প্রাচ্যে ইসলামী স্থাপত্যের সৃজনশীলতার অনন্য শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিবেচনা করা হয়।

এটি নির্মাণ করেন সে সময়ের সেনা কমান্ডার ইয়ালা বাগতুশ বাহাদুর। পাশেই অবস্থিত বিবি খানম মসজিদের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার অভ্যন্তর নামাজ আদায়ের উপযুক্ত ছিল না, তিলইয়া-কুরি মাদরাসায় যেন নামাজও আদায় করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেও এটি নির্মাণ করেন তিনি। মূল স্থাপনা নির্মাণে প্রচুর মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। পাথুরে নকশার অনেকটা জুড়ে সোনালি রঙের বাহার-এজন্য ফার্সি ভাষার নামের মধ্যে সেটি ফুটে উঠেছে, বাংলায় যাকে বলা যায় স্বর্ণাচ্ছাদিত। প্রাচীরগুলোতে কুফি লিপির আরবি ক্যালিওগ্রাফি ভবনগুলোর নান্দনিকতা বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। ২০০১ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নিবন্ধিত করেছে।

মাদরাসার প্রধান ফটকটি বেশ অভিজাত। ফটকের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছাত্রাবাস। দক্ষিণ পাশে একটি স্বাড়ম্বর মসজিদ। তার ওপরে আলো বিচ্ছুরণ করছে বর্ণোজ্জ্বল সুবিশাল একটি গম্বুজ। মসজিদ অভ্যন্তরের কেন্দ্রে রয়েছে মরমর পাথরের একটি নান্দনিক মেহরাব। সামনে সুবিশাল বিস্তৃত চত্বর।

তিলইয়া-কুরি এবং উপরোল্লিখিত দুই মাদরাসার প্রধান ফটকগুলো দেখতে প্রায় কাছাকাছি ডিজাইনের-এজন্য ছবি দেখে মাদরাসাগুলো নির্ণয়ে অনেকের দৃষ্টিভ্রম হয়। কিন্তু আকর্ষণীয় স্থাপত্যসৌকর্য ও চোখ জুড়ানো সাজসজ্জায় তিলইয়া-কুরি মাদরাসা বাকি দুটি থেকে বেশ আলাদা।

কাঠের তৈরি দরজাগুলোতে মার্বেল পাথর খচিত রকমারি ডিজাইন শুরুতেই মুসুল্লি-দর্শানার্থীকে বিমুগ্ধ করে। ১৭ শতকে নির্মিত যতসব সুন্দর স্থাপনা রয়েছে সৌন্দর্যের দিক থেকে সবগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে তিলইয়া-কুরি মাদরাসা।

১৮১৭ সালে এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে মাদরাসার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, বিশেষত এর সামনের দিকটা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে পড়ে। পরে ১৮৮৫ সালের আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এটিকে সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করা হয় এবং সবশেষ ১৯৫০-১৯৫৮ এবং ১৯৭৪ সালে তার হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে সামনের দিকটাকে নতুন করে সাজানো হয়।

মাদরাসা চত্বরটি বলশেভিকদের মধ্যকার সংঘাত এবং মধ্য এশিয়ার মুক্তি আন্দোলনে বেশ ভূমিকা রাখে। এখানে দীর্ঘদিন অসংখ্য রাজনৈতিক, সামরিক ও বিচারসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোভিয়েত যুগে এটি অনাদর-অবহেলায় বন্ধ পড়ে ছিল। পরে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।

তথ্যসূত্র : ইউরোপিয়ান মুসলিম ডট ওআরজি এবং ইয়ালাবুক আরবি


আরো সংবাদ



premium cement