২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনাকাল : দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা

করোনাকাল : দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা - ছবি : সংগৃহীত

তপ্ত মরুর বুকে ধনুকের মতো বেঁকে আছে রুগ্ণ পৃথিবী। সময়ের বারুদে পুড়ে তার গগনবিদারী ফিসফিস আওয়াজ, থেকে থেকে ছায়াভেদি মহামারীরূপে মানব দরজায় টোকা দিয়েছে বারবার। আর মানুষ প্রতিটি মহামারীকে পরাস্ত করেছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুগত হয়ে আত্মশুদ্ধির নীরব প্রার্থনায়। করোনা মহামারীর হাত ধরে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি মধ্য শাওয়াল অর্থাৎ প্রায় বলা চলে মধ্য জুনে। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে লকডাউনে মুসলমানদের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রোজা এবং ঈদ পালন করতে হয়েছে, যার নজির ইতিহাসে সত্যিই বিরল!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রচলিত মহামারীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘কোনো রোগ কোনো ভৌগোলিক এলাকায় এর আগে ছিল না, হঠাৎ করে সেই এলাকায় যদি আবির্ভাব ঘটে, তাহলে ওই রোগের জীবাণু ওই এলাকার মানুষের শরীরে অধিক হারে সংক্রমণ ঘটিয়ে মৃত্যুতে পতিত করতে পারে। এতে ভয়াবহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে, যদি কোনো প্রতিষেধক না থাকে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় মৃত্যু বাড়তে পারে।’ এমন সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রোগের ক্ষেত্রে মহামারী উল্লেখ করা হয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন সবার মাঝে এক মহাআতঙ্ক ও আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-কে বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সমগ্র বিশ্ব। করোনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে শুরু থেকেই মুসলমানদের প্রধান দুই মসজিদ-মসজিদে হারাম এবং মসজিদে নববীতে সাধারণ মুসল্লিদের অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়। মক্কা-মদিনায় গণজমায়েত বন্ধ করে নামাজ আদায় হয় ঘরে।

মহামারীর সময় সবার যেমন এদিক-সেদিক অবাধ যাতায়াত করা কোনোভাবেই ঠিক নয়, তেমনি নামাজের জামাত, জুমা এবং আজানের ব্যাপারেও হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। কারণ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করা ও ইসলামী শরিয়তের দিকনির্দেশনা মেনে চলে মহামারী থেকে আত্মরক্ষা করা জরুরি। এসব ক্ষেত্রে কোনো বক্তা বা আলোচকের কথা বা ব্যক্তিগত একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর কোনো বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির আগেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’ (সূরা হাদিদ, আয়াত : ২২) বিশ্বের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ এবং বড় বড় ইসলামিক স্কলাররা আজান, নামাজ, মসজিদে জুমা এবং অন্যান্য জামাতের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেন। আর দ্বিমত থাকলেও অনেকেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করেন।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো এবং দলে দলে ভাগ হয়ে কিংবা মিলিতভাবে অগ্রসর হও।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৭১) বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ সা: বলেন, ‘কুষ্ঠ (মহামারী) রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।’ (সহিহ বুখারি) মহানবী হজরত মুহম্মদ সা: আরো বলেন, ‘যারা সংক্রমণ রোগে আক্রান্ত তাদের উচিত যারা সুস্থ তাদের থেকে দূরত্বে অবস্থান করা।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ইতোমধ্যে লকডাউন তুলে নেয়া হলেও সমগ্র মুসলিম জাতির কর্তব্য হলো এ ভাইরাস থেকে রেহাই পেতে সুরক্ষার যাবতীয় উপায় অবলম্বন করা এবং এটি প্রতিরোধে যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরক্ষাই উত্তম। সবমিলিয়ে নিজেদের সুস্থতার প্রতি সচেতন হতে হবে। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ ঘরে অবস্থান করা উচিত, এটিই শরিয়তের দাবি। আর কোয়ারেন্টিনের এই উদ্ভাবন শরিয়তের আলোকেই হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ২৯)

আসুন পবিত্র জিলহজের দ্বারে তাকাই আমরা, আর কোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচারে কান না দিয়ে নিজেদের মাঝে আশার সঞ্চার করি- ইনশা আল্লাহ খুব শিগগিরই এই শঙ্কা কেটে যাবে। কারণ মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে গুজব। এ প্রসঙ্গে মহানবী হজরত মুহম্মদ সা: বলেন, ‘শপথ সেই মহান সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার পূর্বে) মানুষের প্রতি এমন একসময় আসবে; হত্যাকারী জানবে না সে কেন হত্যা করছে আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। যখন বলা হলো- সেটা কিভাবে হবে? তিনি বললেন- হারাজের (গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ইত্যাদি) কারণে।’ (মুসলিম : ৩৯০৮) তাই আমাদের উচিত লকডাউন না থাকলেও প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না থাকা এবং অধিক পরিমাণে দোয়ায় মনযোগী হওয়া। কেননা এটি মুমিনের হাতিয়ার। আল্লøাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তাতে সাড়া দেবো।’ (সূরা মুমিন, আয়াত : ৬০)।

আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর আমি আপনার পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতিও পয়গাম্বর প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে অভাব-অনটন ও রোগ-ব্যাধি দ্বারা পাকড়াও করেছিলাম; যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে। এরপর তাদের কাছে যখন আমার আজাব এলো, তখন কেন কাকুতি-মিনতি করল না?’ (সূরা আনআম, আয়াত : ৪২-৪৩)। তাওবা ও ইস্তেগফারের মধ্য দিয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এখন আমাদের প্রধান কাজ। সেই সাথে সাধারণ মানুষকে বোঝানো ও সতর্ক করাও আলেমদের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুর্যোগের সময় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে। ভোগ্যপণ্যের দাম হাতের নাগালে রেখেই বাড়ির পরিচ্ছন্ন দেয়ালগুলো আল্লাহর জিকিরে পরিপূর্ণ আর মজবুত করে তুলি। দান-সদকার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে প্রতিটি তৃষ্ণার্ত কক্ষ করে তুলি প্রাণবন্ত। আর ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ ছিন্ন করে নিজেদের ঈমান দৃঢ় করে তুলি আমাদের রবের ওপর বিশ্বাস ও নির্ভরতায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement