২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রস্তাবিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসিয়ানের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ

প্রস্তাবিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসিয়ানের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ - ছবি : সংগৃহীত

চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সমঝোতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পটি সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমর্থন লাভ করেছে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় বক্তাগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে – রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক কারণে যেমন হওয়া দরকার পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজনেই অতি দ্রুত হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বর্তমান পাইলট প্রকল্পটি প্রকৃত সমাধান না হলেও স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।

তবে তারা বলেন, এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতামত ও ইচ্ছাকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বরং তাদের প্রয়োজনীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষকরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা এক্ষেত্রে যেমন জরুরি। একইভাবে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এশিয়ার পরাশক্তি চীনের কার্যকরী ও ফলপ্রসু ভূমিকা রাখা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের জন্য বাংলাদেশের পক্ষে আরো ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া ও তৎপরতা চালানো জরুরি।

বাংলাদেশ থেকে মায়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্প নিয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের জি টাওয়ার হোটেলে গত ২৯ মে, ২০২৩ সোমবার MWRC-CNI Global Discourse এর অধীনে MWRC- CNI GLOBAL DISCOURSE On REPATRIATION INITIATIVE FOR ROHINGYA REFUGEES FROM BANGLADESH TO MYANMAR: Strategic Dynamics, Global Support, Engagement of ASEAN and Other Organization (রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রকল্পের গতিপ্রকৃতি; বৈশ্বিক সমর্থন, আসিয়ান (ASEAN) ও অন্যান্য সংস্থার ভূমিকা) শীর্ষক আলোচনা মালয়শিয়াস্থ Muslim World Research Center (MWRC) এবং ক্যাবল নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (CNI), বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল OIC Study Group (OICSG), University of Malaya (UM) Department of Islamic History and Civilization ও Dhaka Forum । অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মূল বক্তব্য প্রদান করেন মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ওআইসি স্টাডি গ্রুপের চেয়ারম্যান তানশ্রী ডঃ সৈয়দ হামিদ আলবার। Bangladesh University of Professionals (BUP) এর এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি ও এমডব্লিউআরসির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. শাফায়াত আহমদ লিখিত রিপোর্ট গবেষণা রিপোর্ট পাঠ করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি (BU), বাংলাদেশের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মোস্তফা হোসেন। ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার অধ্যাপক ড. রোজলান এন নূর-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিসকোর্সটি পরিচালনা করেন এমডাব্লিউআরসি’র প্রেসিডেন্ট ও ওআইসি স্টাডি গ্রুপের সেক্রেটারি জেনারেল ড. ইশারফ হোসেন।

নির্ধারিত আলোচক হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ কো কিং কি, ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (ISIS), মালয়শিয়ার প্রাক্তন সিনিয়র ফেলো বান নাগারা, মালয়শিয়া সরকারের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত দাতো ইয়াহিয়া আব্দুল জাবার, সিএনআই-এর চেয়ারম্যান জনাব আশফাক জামান, সেজাহতেরা লিডারশিপ ইনিশিয়েটিভ এর সিইও প্রফেসর ড. জুল বাহারাম, MWRC এর Distinguished Fellow প্রফেসর দাতো বাহারউদ্দিন আহমদ, মাহসা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল বাশার, International Islamic University, Malaysia (IIUM) এর অধ্যাপক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং ABIM-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাহমি শামসুদ্দিন।

মূল বক্তব্যে তানশ্রী ড. সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সমঝোতায় প্রস্তাবিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আসিয়ানের অবশ্যই অংশগ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন প্রদান জরুরি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে যা বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে হবে এবং সেইসাথে এই ধরনের সংকট মোকাবেলার হুমকির বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। রোহিঙ্গারা যখন নিজ দেশে গণহত্যার শিকার হচ্ছিল তখন তাদের বাংলাদেশের ভূমিতে আশ্রয় দেওয়া এবং এ সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য তিনি বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

তিনি বলেন, মায়ানমারের মত রাষ্ট্রের সাথে যখন মোকাবিলা করতে হয় তখন আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োজন কিন্তু যথাযথ প্রয়োগকারী সংস্থা বা বাহিনী না থাকার কারণে আন্তর্জাতিক আইন পর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হলেঅ জাতীয় আইন এবং আঞ্চলিক শক্তির পাশাপাশি আঞ্চলিক সংগঠন।

তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, একটি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য আসিয়ানের উচিত চীনকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের সাথে একসাথে কাজ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত নথিভুক্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে আসিয়ান দেশগুলো বিশ্বাস করে যে এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় যা আসলে ঠিক নয়।

অন্যান্যের মধ্যে সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট কো কিং কি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনীতিকরণ ও ভূ-রাজনীতিকরণ করা ঠিক হবে না। চীনের উদ্যোগে বর্তমানে নেওয়া উদ্যোগটির ক্ষেত্রে আসিয়ানের সক্রিয় অংশগ্রহণসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ ও সহযোগিতায় মায়ানমারের সাথে এই সমস্যা নিয়ে কাজ করা দরকার। বিশেষ করে কোনোভাবেই এই এই উদ্যোগের সাথে আসিয়ানের দূরে থাকা ঠিক হবে না। একই সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মায়ানমারকে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি অটোনামাস অঞ্চল তৈরি করে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা উচিৎ।

ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (ISIS) প্রাক্তন সিনিয়র ফেলো বুন্ন ণেগারা বান নেগারা মনে করেন বর্তমান প্রত্যাবাসন উদ্যোগটি একটি পাইলট প্রজেক্ট। ফলে এর বিরোধিতা বা শর্ত আরোপ না করে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর সত্যিকারের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা যায়। ফলে আসিয়ানসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ জরুরি।

তিনি আরো বলেন যে- বর্তমান উদ্যোগটি মায়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একটি কার্যকর সংলাপের সুযোগ সৃষ্টি করবে। মায়ানমারের জান্তা সরকার পাবলিকলি হয়তো অনেক কিছুই সামনে আনতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে তাদের সাথে ক্লোজড ডোর বৈঠকে যেতে হবে। তাদেরকে এই প্রক্রিয়ায় ইফেকটিভলি নিয়ে আসতে হবে।

আলোচনায় বক্তাগণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনীতির সমন্বয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদাননির্ভর সহায়তার বিপরীতে অর্থনৈতিক সমাধান তহবিল তৈরি করা, তাদের জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া এবং তাদের জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

তারা উল্লেখ করেন যে- বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই মায়ানমার কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে যা ছোট পরিসরে হলেও প্রতীকীভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার যে অমানবিক ও বর্বর আচরণ করেছে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়াও অব্যাহত রাখা জরুরি। তাছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত এ সমস্যার স্থায়ী এবং রাজনৈতিক সমাধান না হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আর্থিক ও মানবিক সংকটের উত্তরণে বাংলাদেশের পাশে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসা দরকার।


আরো সংবাদ



premium cement