২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছেই

-


২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। সারা বিশ্বেই নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে এ দিবসটি পালন করা হয়। পালন করা হয় বাংলাদেশেও। প্রশ্ন হলো নারী নির্যাতন কি কমেছে? কর্মক্ষেত্রে, ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতিত হচ্ছেনই। সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতিত হচ্ছেন তার পরিবারে। এসব নিয়ে লিখেছেন ইসমাইল মাহমুদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত একটি সিমেন্ট কোম্পানির বিক্রয় ম্যানেজার অপূর্ব রায় ও সদ্য মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া দীপা রানী দেবনাথ একে অপরের প্রেমে পড়েছিলেন। মাত্র ৯ মাস আগে তারা পরিবারের সম্মতি ছাড়াই প্রেমের শুভ পরিণয়ের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু এই ভালোবাসা শেষ হয়ে যেন পরিণত হলো বিভীষিকায়। গত ৬ নভেম্বর দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভালোবাসার স্ত্রী দীপার লাশ রেখে পালিয়ে গেলেন স্বামী অপূর্ব।
সম্প্রতি দীপা প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গত ২৫ অক্টোবর ভাইভা পরীক্ষা দেন কিশোরগঞ্জ অষ্টগ্রাম উপজেলায়। এর আগে তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন। এ খবরে তার স্বামী, শাশুড়ি ও ননদ খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তারা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অপূর্ব তার ভালোবাসার স্ত্রী দীপাকে সাফ জানিয়ে দেনÑ এখন সন্তান নেয়া যাবে না। এই সন্তান লালনপালন করার সময়-সুযোগ তাদের নেই। তাই ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে গর্ভপাত করাতে স্বামী অপূর্ব দীপাকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কিন্তু দীপা তার গর্ভের সন্তানের মা হওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ফলে তার ওপর শুরু হয় স্বামী, শাশুড়ি ও ননদ কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে তারা দীপাকে বেদম প্রহার করে এবং ৬ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে দীপার লাশ রেখে পালিয়ে যায়। খবরটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার হলে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। দীপা হত্যাকাণ্ড একটি ঘটনা মাত্র। এ রকম অসংখ্য ঘটনা, অর্থাৎ স্বামীর দ্বারা স্ত্রী হত্যা এ দেশে চলছেই। শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৫২ জন গৃহবধূ। প্রতি মাসে গড়ে ১৭ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হচ্ছেন বলে নারী অধিকার কর্মীরা জানান।
নারীর অধিকার ও সুরক্ষায় আমাদের দেশে বেশ কিছু আইন কার্যকর রয়েছে। আইন থাকলে কী হবে, অসংখ্য নারী বর্তমানে তার নিজগৃহেই অরক্ষিত। পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে নারী প্রতিকূলতাকে জয় করে সম্মুখপানে এগিয়ে যান, সেই নারীরা সর্বক্ষেত্রেই পরিবার ও সমাজে চক্ষুশূল হিসেবে পরিগণিত। ফলে যে পুরুষ নারীর এগিয়ে চলায় নিজেদের কর্তৃত্বের ওপর চাপ অনুভব করেন, সে পুরুষ নারীকে দমনের মধ্য দিয়েই নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চেষ্টা করেন। আর এই টানাপড়েনে দেশে অপ্রতিরোধ্য গতিতে স্বামী বা তার পরিবারের হাতে খুন হচ্ছেন স্ত্রী। নারী অধিকারকর্মীদের অভিমত, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার বেশির ভাগ ঘটনারই বিচার হওয়া তো দূরের কথা; মামলা পর্যন্ত হয় না। তাদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা জরিপে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম ৯ মাসে সারা দেশে ১৫২ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে হত্যাসহ পরিবারে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯৭ জন নারী। এর মধ্যে স্বামীর হাতে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ১৪৫ জন। জরিপের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, এই ১২ মাসে স্বামীর হাতে খুন হন ১৯৩ জন নারী। ২০১৭ সালের ১২ মাসে এ সংখ্যা ছিল ২১৩। আর ২০১৬ সালে ১৯১ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে বর্তমান বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৪ জন নারী স্বামীর হাতে খুনের শিকার হন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছেন তারা। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অধিক। অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে আসে না বলে তাদের অভিমত। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে তারা দাবি করেন, গত ৪৫ মাসে দেশে ৭৯৪ নারী স্বামীর হাতে খুন হলেও মামলা হয়েছে মাত্র ৩৪৭টি। বাকি ৪৪৭টি ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌতুকের জন্য নারীরা সহিংসতা বা হত্যার শিকার হন। চলতি বছরের ৯ মাসে যে ১৫২ জন নারী স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে ৭০ জন হত্যার শিকার হয়েছেন যৌতুকের জন্য। এ ছাড়া এ সময়ে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন আরো ৪৪ জন নারী। আর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহনন করেছেন তিনজন। যৌতুক ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হওয়া, পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস, বিবাহবহির্ভূত স¤পর্ক তথা পরকীয়ার কারণেও গৃহবধূ হত্যাকাণ্ড ঘটছে আমাদের দেশে।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন বিদ্যমান। তবে সমাজে বিশেষ করে প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে ধর্মান্ধতা আছে এখনো। এসব কারণে স্ত্রী হত্যার ঘটনা কমছে না।
নারী এখন শিক্ষিত হচ্ছে, স্বাবলম্বী হচ্ছে। নারীর ভেতরে স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে উঠছে। দেশের বেশির ভাগ নারী স্বাধীনতা চান; যা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজে মেনে নিতে পারছে না। নারীর মনোভাব ইতিবাচক হলেও পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ফলে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনা হ্রাস করা যাচ্ছে না বলে অভিমত নারী অধিকার কর্মীদের।
আমাদের দেশে স্বামীর দ্বারা স্ত্রী খুন বা সহিংসতার ঘটনার পেছনে স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্য তথা শাশুড়ি, দেবর ও ননদের ভূমিকাও কম নয়। চলতি বছর যে ১৫২ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন, তার মধ্যে ১৫টি খুনে স্বামীর সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও জড়িত রয়েছেন।
নারীকে সুরক্ষা দিতে আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ ছাড়া পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন বন্ধে প্রণীত হয় পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০। এ আইনে পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক স¤পর্ক রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তি কতৃক পরিবারের অন্য কোনো নারী বা শিশু সদস্যের ওপরে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝাবে।
আইন থাকলেও অনেক সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যার ঘটনা থানা-আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। বেশির ভাগ ঘটনাই স্থানীয় সালিসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় হত্যার শিকার নারীর পরিবার। তবে নৃশংস ও ভয়াবহ কোনো ঘটনা ঘটলে থানা-আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা বা নারীর প্রতি গৃহসহিংসতা আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর ফল। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর পরিবারের লোকজনও অপরাধে সহযোগী হয়। এর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। আর এটি করতে না পারা মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement