২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মনিকার সংগ্রাম

-

সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের মোল্লারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মনিকা দে। বয়স মাত্র ১২ বছর। পৌর এলাকার ইকড়ছই হলি চাইল্ড নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। এ বয়সেই লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের বোঝা নিয়েছে মাথায়! যখন তার স্কুলে থাকার কথা, তখনই সে লেখাপড়ার পাশাপাশি পান-সুপারির ব্যবসায় করে সাত সদস্যের পরিবারের খরচ বহন করছে।
মনিকারা পাঁচ বোন। সংসারে তারা ছাড়াও রয়েছেন মা ও ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা। এ অবস্থায় পরিবারটি যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন মনিকা কাঁধে তুলে নেয় সংসারের বোঝা। সপ্তাহের সাত দিনকে সে ভাগ করে নিয়েছে দুই ভাগে। সপ্তাহের তিন দিন স্কুলে গিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লেখাপড়া করে এবং স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে দোকানে বসে রাত ৮-৯টা অবধি পান-সুপারি বিক্রি করে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো সে স্কুলে যায় না। এ দিনগুলো সকাল থেকে রাত অবধি ব্যবসায় করে। পরিবারের চরম আর্থিক অনটন, নিজের শিক্ষার খরচ ও দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে সে এ ব্যবসা করতে বাধ্য হয়েছে। তবে এতে মনিকার কোনো আক্ষেপ নেই, বরং পরম তৃপ্তি পায় পরিবারের হাল ধরতে পেরেছে বলে। মনিকা জানায়, প্রথম যখন ব্যবসার হাল ধরে তখন খুব লজ্জা লাগত। পুরো বাজারে একমাত্র নারী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রথম দিকে খুবই সঙ্কোচ বোধ করত। সব সময় তাকিয়ে থাকত মাটির দিকে। কিন্তু এখন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এখন লজ্জা নয়, বরং পরিবারের আর্থিক দৈন্য কাটাতে প্রচেষ্টা চালাতে পারায় নিজেকে নিয়ে গর্বিত সে। মনিকা জানায়, প্রতিবেশী ব্যবসায়ীরা তার প্রতি সব সময়ই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর এ কারণে ব্যবসায় চালাতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মনিকার বাবা পীযূষ দে জগন্নাথপুর বাজারে দীর্ঘ দিন পান-সুপারির ব্যবসায় করে আসছিলেন। তার পান-সুপারি ব্যবসায় পাঁচ মেয়ে ও স্ত্রীসহ পরিবারের ভরণপোষণ, মেয়েদের লেখাপড়া, উপজেলা সদরে বাসা ভাড়া দিয়ে অতি কষ্টে কাটছিল সংসার। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই পরিবারের ওপর নেমে আসে অমানিশার কালো ছায়া। প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন পীযূষ দে। এ সময় চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে চিকিৎসক তাকে জানান, তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। এরপর থেকে ক্রমেই অসুস্থ হতে থাকেন তিনি। এরপরই তছনছ হয়ে যায় সংসারটি। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবারটিও হয়ে পড়ে ঋণগ্রস্ত। পরিবারের বড় মেয়ে রীমা দে পড়ছে জগন্নাথপুর ডিগ্রি কলেজে। দ্বিতীয় মেয়ে সোমা দে ও তৃতীয় মেয়ে মীতা দে সৈয়দপুর আদর্শ কলেজে একাদশ শ্রেণীতে, চতুর্থ মেয়ে মনিকা দে হলি চাইল্ড নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে এবং পঞ্চম মেয়ে লাবণী দে ইকড়ছই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। বাবার এ অসুস্থতায় সব বোনের লেখাপড়া যখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় তখন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় মনিকা দে। বাবার ব্যবসার হাল ধরে সে। এ ছাড়া রিমা ও সোমা টিউশনি ও বিউটি পার্লারে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার খরচ জোগাতে সাহায্য করছে। এসব আয়ে সংসারের খরচের পাশাপাশি তাদের অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ব্যয়ও চলছে।
আত্মপ্রত্যয়ী মনিকা দে জানায়, প্রতি সপ্তাহের শনি, সোম, বৃহ¯পতিবারÑ এ তিন দিন সে স্কুলে যায়। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে গিয়ে বসে দোকানে। এরপর থেকে রাত ৮-৯টা পর্যন্ত দোকানে বসে পান-সুপারি বিক্রি করে। রোব, মঙ্গল ও বুধবার তাকে পুরো দিন ব্যবসায়ের কাজে ব্যয় করতে হয়। ফলে এ দিনগুলোতে তার স্কুলে যাওয়া হয় না।
জগন্নাথপুর বাজার তদারক কমিটির সাধারণ স¤পাদক জাহির উদ্দিন জানান, মনিকা খুবই ভদ্র ও বিনয়ী। তাকে বাজারের সবাই সহযোগিতা করেন। তার যেন কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকে বাজারের সবাই খেয়াল রাখেন। এ ছাড়া অনেক সময় রাতে বাজার থেকে বাসায় যাওয়ার সময় সে যেন নিরাপদে বাসায় যেতে পারে সেদিকে সবাই সজাগ ও সচেতন। অনেক সময় বাজারের ব্যবসায়ীরা তাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেন।
ইকড়ছই হলি চাইল্ড নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান জানান, মনিকা তার স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। তার বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত। তাই তাকে তার বাবার ব্যবসায় দেখতে হয়। বিষয়টি জানার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে। মনিকা পড়ালেখায় খুবই আন্তরিক ও মনোযোগী। যে প্রত্যাশা করে মনিকা দে তার পরিবারের দারিদ্র্য বিমোচনে সংগ্রাম করে যাচ্ছে তাতে এবং শিক্ষার সংগ্রামে অবশ্যই জয়ী হবে সে।


আরো সংবাদ



premium cement