২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভালো চিন্তাভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে : ড. রেবেকা মাস্টারটন ভিন দেশ

-

রেবেকা মাস্টারটন। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, পাবলিক স্পিকার, ইসলামের দার্শনিক, একাডেমিক, টিভি প্রেজেন্টার বা টেলিভিশন উপস্থাপক প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষভাবে পরিচিত। সারা বিশ্ব তাকে জানে একজন ব্রিটিশ ইসলামী পণ্ডিত হিসেবে। লিখেছেন ছোটগল্পও। ‘স্বপ্নের মাধ্যমে অন্য দিকে পাস করা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশ পায় এ সংক্রান্ত একটি সঙ্কলন। মাস্টারটনের জন্ম খ্রিষ্টান পরিবারে হলেও ইসলামে ধর্মান্তরিত একজন নারী। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালের দিকে। তিনি বলেছেন, ‘আমি ইসলামে এমন জিনিস বা কিছু খুঁজে পেয়েছি, যে কারণে অতি আগ্রহেই ধর্মান্তরিত (কনভার্টেড) হয়েছি। শুধু সুন্নি নয়, শিয়া সম্বন্ধেও অনেক বিষয় জানছি। একটি ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হলে তার নানা দিক সম্বন্ধে কমবেশি অবহিত হতে হয়।
তিনি একজন মনোবিজ্ঞানীও। মানুষ যাতে ইসলামের পথে আসে এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলে সেজন্য ধর্মে আগ্রহীদের মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করেন। তার আত্মজৈবনিক কিছু বিষয় (ইসলাম গ্রহণ বিষয়ে) প্রকাশ পায় রিভার্ট মুসলিমস ডটকমে। তিনি বলেন, আমার জন্ম দক্ষিণ ইংল্যান্ডের একটি ছোট শহরে (সাগর তীরবর্তী)। তার মানে এখানেই কেটেছে শৈশব ও কৈশোর। আমার পরিবার খ্রিষ্টান ছিল বলে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না ইসলাম সম্বন্ধে। শুধু শুনতাম, ইসলাম খুব সুন্দর একটি ধর্ম। তবে ছোটকাল থেকে মুসলিমদের আচার-অনুষ্ঠান দেখে আমার বেশ ভালো লাগত। আমার পরিবারের সদস্যরা খ্রিষ্টান ধর্মের বিধিবিধান তেমন একটা পালন করত না। সমাজে থাকতে হলে যা করতে হয়, এই যা। তবে আমার পরিবারের লোকেরা ভদ্র ও সৎ বলে মনে করে অনেকেই।
অনেকে মনে করেন, রেবেকার পরিবারের সদস্যরা তো স্রষ্টা, অদৃশ্য বিষয় প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনে একেবারেই আগ্রহ ছিল না। সেই ঘরে সবার সাথে থেকে রেবেকা যে ইসলামের প্রতি ঝুঁকেছে তা রীতিমতো অবাক করা ঘটনা। রেবেকা মাস্টারটন বলেন, অনেক আগে থেকে আমার খুবই আগ্রহ ছিল অদৃশ্যের জ্ঞানের বিষয়ে। কমবেশি পড়েছি প্রাচীন নানা ধর্ম সম্পর্কে। অনেক বেশি পড়েছি সেই প্রাচীন মিসরীয় ও ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্ম বিষয়ে। অনেকে ধর্মের কথা বলে ঠিকই; কিন্তু অনেকের মধ্যে কৃত্রিমতা থাকে বলেও মনে হয়েছে। ভাবলাম ইসলাম, প্রকৃতি, ঐশীবাণী, আত্মা, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি সম্বন্ধে জানতে হলে প্রচুর পড়ালেখার কোনো বিকল্প নেই। একটি সময়ে আমাকে মালয়েশিয়া যেতে হয়েছে। আর এটাই প্রথম কোনো মুসলিম দেশ ভ্রমণ। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াই ট্রেনে চড়ে। দেখা গেল কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষের ধর্মের প্রতি খুবই টান। সেখানে আমি অজু ও নামাজ শিখি। মসজিদেও যাই। তবে খুব বেশি দিন থাকিনি মালয়েশিয়ায়। অল্প কয়েক দিন অবস্থানেই মনে হচ্ছিল এই দেশই আমার জন্মভূমি। হৃদয়ে এমন শান্তি অনুভব করি, যা অতীতে কখনো পাইনি। এসব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইংল্যান্ডে আমার জীবন যেন অর্থহীন! ব্রিটিশ সমাজের মানুষের তুলনায় এদের জীবন অনেক বেশি সুন্দর ও পবিত্র।
১৯৯৬ সালের দিকে তাকে মিসরে যেতে হয়। সেখানে লেখাপড়া চলে প্রায় ছয় মাস। তাকে রীতিমতো মুগ্ধ করেছে সেখানকার মুসলিম নারীদের জীবনধারা। একপর্যায়ে তিনি হিজাব কেনেন এবং তা পরিধান করেন। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, রমজান মাসে মানুষ কতটা আল্লাহভক্ত হয়। রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে যায় ইফতারের সময়। রাস্তায় খুব একটা চলতে দেখা যায় না যানবাহন। এসব দেখে বিস্মিত হই আমি। ওখানকার মানুষ আমাকে বেশ আপন করে নেয়। আর এসবই পরিবর্তন এনে দেয় আমার জীবনে। মিসর থেকে ফিরে আসার পর ইসলাম সম্বন্ধে আমার আগ্রহ আরো বাড়ল। সেখানে থাকার স্মৃতিগুলো একেবারেই ভুলতে পারছি না। অবশেষে আমি কুরআন পড়া শুরু করে দেই। পাশাপাশি লন্ডনের বহু মসজিদ পরিদর্শন করি। মুসলিম হওয়ার পর ইসলাম সংক্রান্ত নানা স্বপ্ন দেখতেও শুরু হয়, যা আমার কাছে বিস্ময়ের মনে হতে লাগল।
রেবেকা মাস্টারটন পড়াশোনা করেছেন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এবং আফ্রিকান স্টাডিজে (এসওএস বিশ্ববিদ্যালয়)। এটি লন্ডনের একটি পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি দেশটির ফেডারেল ইউনিভার্সিটির একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিএ করেন জাপানিজ ভাষায়। এমএ করেন পূর্ব এশীয় ও আফ্রিকান সাহিত্যে। আর পিএইচডি করেন ইসলামী রহস্যয়ী সাহিত্যে।
রেবেকা মাস্টারটন সম্মিলিত গবেষণামূলক কাজ করেছেন, যাতে করে তার এ সংক্রান্ত কাজগুলো দর্শনের সাথে ইসলাম এবং তুলনামূলক সাহিত্য উৎকর্ষ সাধনে কাজ দেয়। পাশাপাশি কাজ করেছেন ইরানি গণমাধ্যম, সম্প্রচার এবং কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে। এর আগে কাজ করেছেন বার্কবেক কলেজে। তার মানে এটি লন্ডনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এটি একটি পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে তিনি শিক্ষা দেন ইসলামী রহস্যবাদ বিষয়ে। তার অর্থ সুফিবাদ। এর মধ্যে মানুষের মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রয়েছে। তিনি একটি ধারাবাহিক উপস্থাপনার কাজ করেছেন প্রেস টেলিভিশনে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ে। প্রেস টিভি (পিআরএসএসটিভি) একটি ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজি ভাষার চ্যানেল। সংবাদ এবং ডকুমেন্টারি নেটওয়ার্কের কাজ করে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান ব্রডকাস্টিং বা আইআরআইবির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে। এর সদর দফতর অবস্থিত তেহরানে। এদিকে আহলবায়েত টেলিভিশনে বিশেষ সাক্ষাৎকার নেন ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের। এটি ইংরেজি ভাষার ইসলামিক টিভি চ্যানেল। এর কেন্দ্রস্থান লন্ডন। তিনি সিনিয়র লেকচারারের দায়িত্ব পালন করেন লন্ডনের ইসলামিক কলেজে। এর আসল পাঠ্য বিষয় হলো ইসলামিক পরিবেশে উচ্চশিক্ষা। এটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান। এতে আছে বিএ, এমএ, ডক্টরেট। এখানে পড়ানো হয় ইসলাম সম্পর্কে ‘অন্তর্দৃষ্টিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি’ বিষয়। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও পড়ানো হয় যতœসহকারে।
তিনি একজন ভালো বক্তাও। প্রচুর বক্তৃতা দিয়েছেন কানাডা ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ব্যাপক বক্তৃতা দেন আমাদের অধিকার, গণতন্ত্রের স্বাধীনতা, ধর্ম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। বিভিন্ন্ দেশের মুসলিমদের কী করণীয় এবং কী অবস্থায় তারা আছে তারও ব্যাখ্যা দেন। বহু নারী ও শিশুও নানা সমস্যায় রয়েছে। এদের প্রতি অবিচারও করা হচ্ছে নানা কায়দা-কৌশলে। তিনি বলেন, আমরা তা চাই না, চাই একটি শান্ত সমাজ। কেননা ইসলামধর্ম শান্তির ও স্বর্গীয়। আমি আমার বক্তৃতা, লেখালেখি, শিক্ষকতা, প্রকাশনা প্রভৃতি চালিয়ে যাবো সব প্রজন্মের জন্য। আমরা চাই সাহসী মানুষ। তাছাড়া সুনীতি প্রতিষ্ঠা করা খুবই কষ্টকর। জীবন মানে হৃদয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব ধারণ করা। ধর্মযোদ্ধারা সাহসের সাথে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তিনি আরো বলেন, কুরআন বলে দিয়েছে, আমাদের অন্তরে ভালো চিন্তাভাবনা আছে। আর তা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. মাস্টারটন মিডিয়াতে কাজ করেছেন দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর। অনুষ্ঠানমালা নির্মাণ ও উপস্থাপনা করেছেন সাহারা টেলিভিশন এবং হাদি টেলিভিশনেও। হাদি টিভি মুসলিমের ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠান নির্মাণও করে। এর স্লোগান হচ্ছে, আমাদের রাসূল সা:-এর শিক্ষা প্রচার করা আর সাহারা টিভি সম্প্রচার করে প্রায় সাধারণ অনুষ্ঠানমালা।
তার প্রকাশনা ভাণ্ডারও বেশ ভারী। প্রকাশিত বইয়ের নামগুলো হলো ফার্সি থেকে অনুবাদ করা হজের অভ্যন্তরীণ মাত্রা, ফরাসি থেকে অনুবাদ কুরআনের নৈতিক বিশ্ব, ইউরোপের আধ্যাত্মিকতার ইতিহাস। তার প্রবন্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছেÑ ফিলিস্তিনের জন্য ৩০০০ বছরের যুদ্ধ, ‘ইরানে হিজাব : অর্থের অনেকগুলো ছায়াছবি, সুজনতা : ১৩ শতকের আফ্রিকার একজন মুসলিম বীর প্রভৃতি।
মানুষের মনের উৎকর্ষ সাধনের জন্যই ড. রেবেকা মাস্টারটন লেখালেখির সাথে যুক্ত রয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement