২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবতার সেবায় সানজানা শিরিন

-


মৌলভীবাজারসহ সিলেট অঞ্চলে তিনি ‘রক্তকন্যা’ নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের কোথাও কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই রোগীর আত্মীয়স্বজন প্রথমেই যাকে স্মরণ করেন তিনি সান জানা সাঞ্জু শিরিন। দ্রুত রক্ত সংগ্রহ করে দেয়ার মাধ্যমে রোগীর পরিবারে হাসি ফোটানোর কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। এ কাজে তার কোনো ক্লান্তিবোধ নেই। যখনই যার রক্তের প্রয়োজন হয় সেটা দিন হোক বা রাত দ্রুত রক্তের সন্ধানে ছুটে চলাই তার ব্রত।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরস্থ ক্যামেলিয়া ডানকান ব্রাদার্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত শিরিন রক্ত ছাড়াও আরো একটি কারণে সবার কাছে পরিচয়ের পরিধি করেছেন সমৃদ্ধ। কর্মজীবনের প্রায় দুই বছরে তিনি ৪২৮টি শিশুর নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন তিনি। কোনো রোগীকে সহজে সিজার করাতে দিতে তিনি রাজি নন। সিজার ছাড়া ডেলিভারি করানোই যেন তার এক অদম্য নেশা। এ কাজেই যেন তার পরিপূর্ণ সুখ। প্রতিটি ডেলিভারি শেষে তৃপ্তিকর হাসিমুখে নবজাতককে নিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি। প্রতিদিনই তার ফেসবুক টাইমলাইনে বাড়ছে নবজাতক শিশুর ছবির সংখ্যা।
সান জানা সাঞ্জু শিরিনের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। তারা আট ভাইবোন। শিরিন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়। এইচএসসি পরীক্ষার পরই তিনি মেডিক্যাল অ্যাসিস্টান্ট ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হন। এ কোর্স শেষ করে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মৌলভীবাজারের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি জীবন শুরু করেন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) মা-মণির এইচএস প্রজেক্টে প্যারামেডিক পোস্টে নিয়োগ লাভ করেন। এরপর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এফআইভিডিবিতে প্যারামেডিক পদে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কমলগঞ্জের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন।
সান জানা সাঞ্জু শিরিন বলেন, ‘দেশে সিজারের মাধ্যমে শিশুর জন্মদানের হার ক্রমেই বেড়েই চলেছে। অনেক সময় অহেতুক সিজারের বলি হতে হয় রোগীকে। এ কারণে মা ও নবজাতক শিশু দুজনের জীবনেই ঝুঁকি বাড়ছে। আমি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সিজার ছাড়াই শিশুর জন্মে কাজ করতে চাই। একজন মা ডেলিভারি আগে ৪৫ ভোল্ট ব্যথায় কাতরান। কিন্তু আমি যখন তাকে ব্যথা থেকে রিলিফ দিতে সাহায্য করি তখন তিনি শান্তি পান। সেই শান্তির হাসি আর নবজাতকের কান্না আমার মনে প্রশান্তি দেয়। তাই গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারি করানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।’
শিরিনের মতে, নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সিজার নয়, নরমাল ডেলিভারির কোনো বিকল্প নেই। সিজারে বাচ্চা প্রসব করাতে গিয়ে গর্ভবতী মা অনেক চরম ঝুঁকিতে থাকে। প্রথমবার সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা হলে একজন নারী দ্বিতীয়বার মা হতে গেলে ঝুঁকি থাকে ৯০.৭ শতাংশ। এ ছাড়া অনেক সময় ছুরি-কাঁচি লেগে শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি হয়। মায়েরাও ভোগে ইনফেকশনে। সিজার করার পর একজন মায়ের পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নরমাল ডেলিভারি করানোর দুই ঘণ্টার মধ্যে একজন মা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। এতে মায়ের কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
সান জানা সাঞ্জু শিরিন বলেন, ‘আমাদের জীবনটা অনেকটা যুদ্ধের মাঝে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টার মতো। সব সময় সব স্থানেই প্রতিটি মুহূর্তে যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয়। জীবনের পদে পদে বিপদের হাতছানি। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিচ্ছিল সড়ক দিয়েই যেন আমাদের যাতায়াত। আমার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ভালো কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধ করছি প্রতিনিয়তই। নরমাল ডেলিভারি করাতে গিয়ে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। অনেক সময় অনেকের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে।’


আরো সংবাদ



premium cement