২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
আমিও বলতে চাই

এই নিয়ে সংসার

-

আম্মা হাসছেন। হাসলে আম্মাকে এত সুন্দর লাগে, জানতাম না। এটা সত্যি কথা যে জীবনে আজই আম্মাকে এতো প্রাণ ভরে হাসতে দেখেছি। স্বামীর নির্যাতন, অবহেলা আর করুণা পেয়ে পেয়ে জীবনটাকে চিরকাল দুর্বিষহ মনে করা আমাদের আম্মা হাসতেই ভুলে গেছেন। আমাদের মধ্যবিত্ত বাবা তার সংসার জীবনে আমাদের চার ভাইবোনের জনক হতে পেরে কতখানি সুখী জানি না, কিন্তু আম্মাকে নিয়ে তিনি যে সুখী নন, এটা আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি। সংসারে বাবা কেন সুখী নন, তার কাছে এই প্রশ্নের সোজা জবাবÑ শাহানার গায়ের রঙ কালো।
আমাদের আম্মার গায়ের রঙ কালো এবং চেহারা ভালো না। এই সমাজে কালো মেয়েদের মূল্য কতখানি, এটা আম্মা তার জীবন-যৌবন বোঝার পর থেকে বুঝতে পেরেছিলেন কি না জানি না, কিন্তু আমার বিত্তবান নানাজানের পিঠ যে দেয়ালে ঠেকে গেছে এই কালো মেয়েকে নিয়ে, এই গল্প আমরা আত্মীয়স্বজনের মুখে অনেকবার শুনেছি। বয়স বাড়তে বাড়তে আম্মাকে যখন সমাজের নিন্দুকেরা আড়াল থেকে ‘আইবুড়ি’ ডেকে হিংসা করতে শুরু করে, নানাজান তখন ঘোষণা দিলেন তার বয়স ভারি মেয়েকে যে বিয়ে করবে, তাকে প্রচুর সম্পত্তি দেয়া হবে। আমার দাদাজান তার বড় ছেলেকে সেই বয়স ভারি মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে নানাজানের ঘোষিত সম্পত্তির মালিক হলেন।
একে একে জন্ম হলো আমাদের সব ভাইবোনের। বড় হতে হতে আমরা দেখে আসছি আমাদের আম্মা আব্বা একই ছাদের তলায় বাস করার পরও দুইজনের এক অপার দূরত্ব। এই দূরত্বের কারণÑ আম্মা দেখতে কুৎসিত। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে এই কুৎসিত বউকে নিয়ে যাওয়ার কথা আব্বা কল্পনাও করতে পারেন না। দাম্পত্য জীবনে আম্মাকে অবলা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি আব্বা। দাদাজানের সাথে আব্বার খানিক বিরোধ ছিল এই অচল মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে আনার কারণে। কোনো ছুতা পেলেই শারীরিক নির্যাতনে আব্বা হন্য হয়ে উঠেন। তবুও স্বামীর প্রতি আম্মার কোনো অভিযোগের পাহাড় জমে থাকে না।
সেই আম্মা আজ এত মধুর হাসছেন। এই হাসির কারণ জানতে চাইলে আম্মা বলেন, ‘ডাক্তার আজ ফাইনালি জানালো তোর বাবার ডায়াবেটিস নাই।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এই জন্য এত খুশি হতে হয়?’ আম্মা বললেন, ‘হ্যাঁ। ডায়াবেটিস হলে তোর বাবা ইনসুলিন নিতে শরীরে যে ব্যথা পেত, তখন খুব খারাপ লাগত আমার।’ আম্মার কথায় আমি আকাশ থেকে পড়ে বললাম, ‘আব্বা তো আপনাকে অশান্তিতে জ্বালায়। তার রোগ মুক্তিতে এত আনন্দ?’ আম্মা হেসে বললেন, ‘অশান্তি নয়। এটাই সংসার। তোদের বাবাতো আর আমাকে মেরে ফেলেননি। সেদিন খবরে দেখলাম খুলনায় এক পাষণ্ড স্বামী তার বউকে মেরে লাশ বস্তায় ভরে ডোবায় পুঁতে ফেলেছে। তোদের বাবা কি আমাকে এমন করেছেন?’
আম্মার কথায় আমার বুক খাঁ খাঁ করে উঠল। আমি জানি এই সমাজে আমাদের আম্মার মতো অনেক নারী আছেন, যারা বদসুরত, কুৎসিত আর আনকোরা চেহারার কারণে স্বামী কর্তৃক তথা এই সমাজেও উপহাসের প্রাণী মাত্র।
আমি কিছু ভাবছি দেখে আম্মা বললেন, ‘শোন, তোদের বাবা আমাকে যতই অবহেলা করুক, আমার টুঁ শব্দ নেই। কারণ সংসারটা আমার।’ আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকি। ইচ্ছে করছে আম্মাকে বলিÑ আপনি একজন মহিয়সী নারী।
জোবায়ের রাজু
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement