২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বাবা আমার অহঙ্কার আমার গর্ব : আরজিনা খাতুন, সহকারী কমিশনার, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা

-

আমার স্নেহশীল বাবার নাম আহমেদ আলী। মা-মতি বেগম। আমরা দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আমি বড়। আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ হতদরিদ্র সাধারণ কৃষক। যার কাজ নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। ছোট্টবেলায় ভীষণ অভাব-অনটনে আমার বেড়ে ওঠা। আমার বাবার বয়স যখন মাত্র ১৩-১৪ বছর, তখন বজ্রপাতে দাদা মারা যান। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দাদীও মারা যান। কিশোর বাবার ওপর তখন দেড় বছর, তিন বছর, পাঁচ বছরের ভাইবোনদের দায়িত্ব। দাদার নিজের কিছু জমিজমা ছিল কিন্তু কোথায় কেমন অবস্থায় আছে তা জানা বা বোঝা বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই নিজে গতর খেটে ভাইবোনদের কোনো মতে বড় করে তোলেন। আমার বাবা লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত একজন মানুষ, যিনি আমার সার্বক্ষণিক গাইড, বন্ধু ও ফিলোসফার। আমার বাবার প্রতিটি শব্দে, আচরণে ছিল বিশাল ব্যক্তিত্বের আভাস। তিনি ধানক্ষেতে কাজ করলেও তার মেয়েকে নিয়ে ছিল আকাশচুম্বী স্বপ্ন। আমার স্বপ্নচারী বাবা ভাবতেন আমি তার রাজকন্যা। বাবা আমার মুখ দেখে ভীষণ খুশি হয়ে বলেছিলেন, দেখো, আমার মেয়ে একদিন এই গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে। ঠিক তাই। আমার গ্রামে আমিই প্রথম এসএসসি, অনার্স-মাস্টার্স ও বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। আমাদের গ্রামের নাম তালুকপাড়া, থানা-বালিয়াকান্দি, জেলা-রাজবাড়ী। আমি যে গ্রামে বাস করতাম, সেটা ছিল বাংলাদেশের অত্যন্ত অনুন্নত বিল হাওর এলাকা। আমাদের বাড়িটার দুই দিকে বিল, পানিতে থৈ থৈ মাঝখানে ছোট্ট বেড়া, ছন, বাঁশকাঠির ঘর, কোনো মতে জীবনযাপন করা। শুষ্ক মওসুমে বাবা ধান, সবজি চাষ করে টাকা-পয়সা উপার্জন করতে পারতেন কিন্তু বর্ষায় আমাদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। বাবা তখন বিল থেকে মাছ মেরে বাজারে বিক্রি করে খাবারের ব্যবস্থা করতেন। আমার যখন ৫-৬ বছর বয়স। বাবা তখন আমাকে আদর্শলিপি কিনে দেন। আমি যথারীতি বাড়ি থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরের এক স্কুলে ভর্তি হই, ইসলাম মোল্লা নামের চাচার মাধ্যমে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে। সেই থেকে পথ চলা। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে একা একা স্কুলে চলে যেতাম। দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার পরই ছিল বিশাল হাইওয়ে। বড় বড় ট্রাকগুলো যখন বিকট আওয়াজ করে আসতে থাকত, তখন আমার ছোট্ট বুকটা থরথর করে কাঁপত। আমি ভয়ে আতঙ্কে রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে মাথা নিচু করে কান বন্ধ করে শুয়ে পড়তাম। আমার স্কুল টাইম খুব সম্ভব সকাল ৯টার দিকে ছিল কিন্তু আমি রওনা দিতাম ভোর ৬-৭টার দিকে। তা না হলে ক্লাসে পৌঁছা যেত না। এমনি করে কোনো মতে ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ার সময় একদিন ক্লাসে পড়া না পড়ার কারণে ও খারাপ রেজাল্ট করার জন্য শ্রেণী শিক্ষক আমাকে এমন মার মারলেন যে আমার শরীর, হাত-পা দিয়ে রক্ত ছুটে গেল। পরে ১৫-২০ দিন আমি বিছানা থেকেই উঠতে পারিনি। বাবা সব শুনে শিক্ষকের ওপর এতটুকু রাগ করলেন না বরং বললেন, স্যার তো ঠিকই করেছেন। আমার মনেও জিদ চাপল আমি পড়া কেন পারব না। আসলে আমি পড়াশোনা করতাম কিন্তু সেটা প্রপার ওয়েতে হতো না। ক্লাসে শিক্ষকেরা কী পড়াতেন সেটাও আমি বুঝতাম না। তা ছাড়া বাসায় পড়া বলে দেয়ার মতো এমন কোনো মানুষ আমার পাশে ছিল না। অতঃপর বাবা তার ফুফাতো ভাই আফজাল চাচাকে আমাকে পড়াতে অনুরোধ করলেন। আমি কয়েক গ্রাম পার হয়ে চাচার বাসায় পড়তে গেলে চাচীও আমাকে পড়াতেন রান্না করতে করতে। মা তখন চাচীর হাত ধরে বললেন, ‘বু আমাদের তো কিছু নাই, আপনাকে কী আর দেবো? তবে বছর শেষে আমি আপনাকে একটা নাক ফুল বানিয়ে দেবো।’ চাচী খুব ভালো মানুষ, এসএসসি পাস ছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভালোবেসে পড়াতেন। তার পর থেকে আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি রাত জেগে পড়াশোনা করতাম, মা-বাবা দুইজনই আমার সাথে জেগে থাকতেন। কখনো বাতাস করতেন কখনো কুপি নিভে গেলে তা জ্বালিয়ে দিতেন। ক্ষুধা লাগলে মুড়ি চিঁড়া খেতে দিতেন। ক্লাস থ্রির পড়া শেষ করতে করতেই পাশের গ্রামে এমপিওভুক্ত একটা স্কুল হয়। নাম কাশেম মণ্ডল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওখানে আমি ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করি। ওই স্কুলের আলম স্যার আর হাশেম স্যার আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে নেন অর্থাৎ কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাকে পড়াতেন স্কুল ছুটির পর। ক্লাস এইটে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর হাইস্কুলের শিক্ষকদের নজরে পড়ি। তারাও আমাকে পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করেন। বিশেষ করে শহীদুল ইসলাম স্যার। আমার ছোট দুই ভাই মতিউর রহমান ও রবিউল ইসলাম এসএসসি পাস করার পর নন কমিশন র্যাংকে আর্মিতে যোগদান করেন। আমি অনার্স মাস্টার্স পড়ার সময় পরীক্ষার ফি, ঢাকায় আমার খরচ সবাই মিলে চালাত। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার উঠে আসার পেছনে বাবা-মা, ভাই, শিক্ষক, চাচা-চাচী, আমার স্বামী আবু হেনা মো: রউফ উল আজমের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।
বিয়ের সময় আমি অনার্স তৃতীয়বর্ষের ছাত্রী। সুতরাং স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া বিসিএস ক্যাডার হওয়াও এত সহজ ছিল না। তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমার যখন বয়স ৬-৭ বছর, তখন বাবা মাঠে কাজ করতেন। আমি স্কুল থেকে ফিরে বাবার জন্য দুপুরের ভাত নিয়ে যেতাম। একটু বড় হতেই বাবার সাথে আমি ধান বুনতাম, ধান কাটতাম। কখনো সবজি বাগান পরিষ্কার করতাম। বাবা বলতে, মা তুই পারবি না, ওটা আমিই করে নেবো নিই। তুই বরং আমার পাশে বসে থাক। অনেক দূর পথ হেঁটে আসতাম বলে বাবার মুখটা কেমন মলিন হয়ে যেত। বাবা আমার ঘামঝরা মুখটা মুছে দিতেন। বাবা খেতে বসলে আমিও বাবাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম। কখনো কাপড় দিয়ে বাবার মাথাটা ঢেকে রাখতাম, যাতে দুপুরের কড়া রোদ থেকে একটু সময়ের জন্য বাবা আরাম করে ভাত খেতে পারেন। আমি জোর করে যখন ধান কাটতাম, তখন বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতেন। কখনো বাবার চোখ বেয়ে তপ্ত পানি গড়িয়ে পড়তেন। বর্ষাকালে জমিগুলো পানিতে তলিয়ে গেলে বাবা হাটবারের দিন পেঁয়াজ রসুন-আদা কিনে আনতেন। আমি বাসায় বসে সেগুলো মায়ের সাথে পরিষ্কার করে বাজারে বিক্রি করতাম। এভাবেই আমাদের সংসার কোনো মতে চলত।
গ্রামের লোকেরা বলতেনÑ মেয়ে মানুষ দু’দিন পর পরের বাড়ি চলে যাবে। এত লেখাপড়া করিয়ে কী হবে? অথচ বাবা বলতেন আমার জন্য না হোক, আমার মেয়ে তার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠুক! প্রজন্মের পর প্রজন্ম আর কত কষ্ট সইবে? তা না হলে জীবন তো জীবনের কাছে ফিরে আসবে না। বাবার এই দূরদর্শিতা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। আজো ভাবি বাবা এতটা ফিলোসফার কি করে হয়েছিলেন, তিনি তো কখনো প্রাইমারি স্কুলও পাড়ি দেননি।
বাবার ধৈর্য, অদম্য মনোবল আজো আমাকে শক্তি জোগায়। ছোট্টবেলা থেকে আমার প্রতিটি রেজাল্টের সময় বাবার সে কী খুশি! সেই খুশি যেন বেহেশতের সুখের চেয়েও অধিক মূল্যবান। আর তাই এত কষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও বাবার জন্য আমার এগিয়ে যাওয়া। বাবা আমাকে কখনো বুঝতে দেননি আমি তার মেয়ে; বরং বুঝিয়েছেন আমি তার যোগ্য সন্তান। ছেলেমেয়ে যে আলাদা কোনো ব্যাপার নয়, বিষয়টা আমি আমার বাবার কাছ থেকেই শিখেছি।
আমি ৩১তম বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার। যেদিন প্রথম আমি জানলাম সত্যিই আমি বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছি। বাবাকে ফোনে প্রথম খবরটা জানালাম। বাবাতো খুশিতে আত্মহারা। তিনি বারবার বলছিলেন মা, তুই সত্যি অফিসার হয়েছিস? বাবা অবশ্য বিসিএস ক্যাডার সম্পর্কে জানেন না কিন্তু মেয়ে তার সরকারি অফিসার হয়েছে এটা বুঝতে পেরেছেন। আমার বাবা খুব আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ। সব সময় বাবার আদর্শ ন্যায়নীতি বোধ, সৎ উপদেশ আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
অনুলিখন : রুমা ইসলাম


আরো সংবাদ



premium cement

সকল