২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আহা! শৈশবের ঈদ

-


ঈদ মানেই আনন্দ। তবে শৈশবের ঈদের যেন তুলনা, সেই তুলনাহীন ঈদের আনন্দের কথাই জানিয়েছেন কয়েকজন কবিসাহিত্যিক। ছোটবেলার সেই ঈদ এখনো মনে পড়ে। মনকে উদাস করে দেয়। সাক্ষাৎকার : আসমা আক্তার

হইহুল্লোড় করে বেড়ানোই ছিল ঈদ : রহিমা আক্তার মৌ সাহিত্যিক
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় দু’টি উৎসবের মাঝে একটি হলো ঈদুল ফিতর। পুরো এক মাস রোজা পালনের পর ঈদের আনন্দই ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। আমাদের ও তাই। ডালাকুলা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মেহেদি সংগ্রহ করা দিয়েই শুরু হতো ঈদ। তার পর রাতে শিল-পাটা নিয়ে মেহেদি বাটতে বসা, সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখতে বাড়ির পশ্চিম পাশে যাওয়া, চাঁদ দেখে ফেরার পথে রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ...। গাইতে গাইতেই জানান দিতাম ঈদ এসে গেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলত মেহেদি দেয়া, গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা-গান। ছোট কাঠি দিয়ে হাতে মেহেদির নকশা আঁকা। আজ আর ভোরে ডাকতে হতো না কারোই। নতুন পোশাক পরা, সেমাই খাওয়া, সেলামি নেয়া, সমবয়সীদের সাথে হইহুল্লোড় করে বেড়ানোই ছিল ঈদ। আর আড্ডা মানেই আমি। মায়ের কড়া শাসনের ছিল বিরতি, তবে হুকুম ছিল সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরা চাই। ঘরে ফিরতে ফিরতে ঈদ শেষ। আমার মতো সবার আনন্দই ছিল এমন। এখনো ছোটবেলার সেই ঈদ মনে পড়ে। সেই ঈদটা এখন মিস করি।

আব্বার হাত ধরে ঈদগাহে যেতাম : শাহানা সিরাজী, কবি ও পিটিআই স্কুলের ইন্সট্রাক্টর

‘ছোটবেলায় ঈদের সময় ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নতুন জামা পরে সবাইকে সালাম দিয়ে সালামি পাই বা না পাই আব্বার হাত ধরে ঈদগাহের দিকে হাঁটা দিতাম। পথে ফুফুর বাড়ি। আব্বা বোনকে না দেখে নামাজে যেতেন না। ফলে ফুফুর সাথে সালাম খাওয়া-দাওয়া করে ঈদগাহে যেতাম। খুব ছোট সময় আব্বার সাথে নামাজে দাঁড়াতাম। একটু বড় হলে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে মেলা থেকে আঙুলি বাঁশি গাড়ি কিনে বাড়ি ফিরতাম। আম্মার রান্না সেই ভোরেই শেষ হতো। হাতে কাটা সেমাই, পোলাও-গোশত, লাচ্চা সেমাই ইত্যাদি খাবার রান্না হতো। পছন্দমতো কিছু একটা খেয়ে বাড়ির অন্যান্য ঘরে যেতাম। খেলতাম, ফুফুর জন্য আম্মার রান্না করা খাবার নিয়ে যেতাম, বিকেলে দাদীর বাপের বাড়ি যেতাম, আরো পরে খালার বাড়ি যেতাম। বাড়িগুলো কাছাকাছি ছিল। এভাবেই দিন কাটত। পরদিন থেকেই লেখাপড়া শুরু। আম্মার কাছে পড়াশোনার ছাড় ছিল না।’
ঈদের দিন মানেই তো আনন্দ উল্লাসের বিশেষ দিন : সাফিনা আক্তার কবি

‘ঈদের দিন মানেই তো আনন্দ উল্লাসের বিশেষ দিন। একটু যখন বুঝি তখনকার কথাÑ আমাদের বিশাল পরিবার চাচাতো ভাইবোন, বড় ভাইয়ের আবার বোনদের ছেলেমেয়েরা সহজেই একত্র হতে পারতাম। ঈদের দিন খুব সকালে গোসল করতাম দলবেঁধে। নতুন জামা আগে কেনা হলেও লুকিয়ে রাখা হতো ঈদের দিন সকালে তা পরার আনন্দই ভিন্ন। ছেলেদের সাথে ঈদগাহ মাঠে চলে যেতাম, ছেলেরা যতক্ষণ নামাজ পড়ত, ততক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম; বেশ ক’জনের একটা দল হতো। নামাজ শেষ হলে একসাথে বাড়ি ফিরে বড়দের সালাম শুরু যে যে বড় মুরব্বি, বাবা-মা সবার। আগে বাড়িতে সেমাই, পায়েস খাওয়া, কখনো গোশত-রুটি। সালাম করলেই কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা, আবার পাঁচ টাকাও পেতাম। পরে আবার ছেলেমেয়েরা মিলে বেড়াতে যাওয়ার বুদ্ধি করতাম। হয় শিশুপার্ক, না হয় চিড়িয়াখানা। সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। সারা দিন ঘুরেফিরে সালামি পাওয়া টাকা দিয়ে এটা ওটা কেনা ভিন্ন খাবার খাওয়া। আবার রাতে ভিসিআর ভাড়া এনে টিভি উঠানে বসিয়ে দিত বড় ভাই। বিভিন্ন নতুন হিন্দি ছবি আর ইংরেজি লাকি সেভেন, ইন্টার দ্যা ড্রাগন, জাকি চ্যানের ছবি। এসব দেখতে দেখতে উঠানে পাটিতে ঘুমিয়ে যেতাম, পরদিন জেগে দেখি ঈদ শেষ।’

ঈদ আসছে আসছে করে একটা ঘোরের মধ্যে কাটত : আনজানা ডালিয়া চাকরীজীবী

‘ঈদ আসছে আসছে করে একটা ঘোরের মধ্যে কাটত। জামা কেমন হবে, জুতা কেমন হবে আদৌ হবে কি না। বাড়ির সামনে বসত মেলা। সবার আগে মেলায় যাওয়ার হুড়োহুড়ি। আর সবচেয়ে টানটান উত্তেজনা হতো নিজের ঈদের জামা লুকিয়ে রেখে ভাইবোনদের কাপড়গুলো দেখে নেয়া। কারণ বাবা রাতে এনে আমাদের ভাইবোনদের সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে যারটা তাকে বুঝিয়ে দিতেন। রাতে ঘুমের ঘোরে জামাটা বুঝে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরতাম। এখনো আমি সেই অনুভূতির স্বাদ নিতে আমার শাড়ি, জামা লুকিয়ে রাখি। ঈদের দিন গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরে একসাথে বের হই। এখন স্থান পরিবর্তন হয়েছে। নিয়ম রীতি, অভ্যাস, খাওয়ার মেনু পরিবর্তন হয়েছে। আগে মা সাজিয়ে গুছিয়ে সেমাই খাইয়ে সবাইকে সালাম করিয়ে মেলায় পাঠাতেন। আর এখন আমিই মা, আমার সন্তানদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে গোসল সারিয়ে সাজিয়ে নামাজে পাঠাই। ওদের পছন্দের খাবারগুলো বানিয়ে টেবিল সাজাই। আমাদের সময়ের মতো এখনকার আমাদের সন্তানরা সেমাই খায় না। ওদের পছন্দ ফালুদা, চটপটি, ক্ষীর মিক্স, হালিম, চিকেন রোল, বিরিয়ানি আরো কি সব নাম যেন। আমি এসব বানাতে বানাতে আমার ছোটবেলার ঈদটাকে খুব মিস করি। আমার পছন্দের তালিকায় ছিল লাল, হলুদ রঙের মিশ্রনে চাকা লাচ্ছা সেমাই। মা ঈদবাজারের লিস্টে সব কিছুর আগে আমার লাল হলুদ সেমাই লিখতেন। খাবারের তালিকা সমৃদ্ধ হলেও আনন্দে যেন তেমন উচ্ছ্বাস থাকে না এখনকার ঈদে। ভাবি, এবার ঈদে এমনটা করব, তেমনটা করব, করি তবু যেন সেই আগের আনন্দ, উচ্ছ্বাসটা পুরোপুরি আনতে পারি না। তবু ঈদের আনন্দ ভাগ করি। ভেদাভেদ ভুলে মিলি সবাই।’

ঈদের দিনে বেড়ানোর মজাই আলাদা : তাহমিনা কোরাইশী কবি কথাসাহিত্যিক

‘যত বড হতে থাকি ঈদের আনন্দ ততই হারিয়ে ফেলি, দায়িত্ব কর্তব্যে মধ্যে আনন্দ বাধা পায়। মনে পড়ে সেই ছোটবেলার ঈদ কি যে আনন্দে কেটেছে, আমার মায়ের সেলাই স্কুল ছিল... তিনি আমাদের জামাকাপড় সবই সেলাই করে দিতেন মেশিনে নিজ হাতে। কত রকমের ডিজাইন করে ওতে এমব্রয়ডারি করে দিতেন। আমাদের ফ্রকে ফুল পাখি লতাপাতা এঁকে এমব্রয়ডারি করে দিতেন। আমাদের কাপড়গুলো সবার থেকে আলাদা হতো, সেই জামাকাপড চুড়ি চুলের ফিতা জুতো স্যান্ডেল সব কিছু লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের আগে কাউকে দেখানো যাবে না, স্কুলের বন্ধু, পাড়া প্রতিবেশী, বান্ধবীদের। আলমারিতে অথবা বিছানার তোশকের নিচে ভাজ করে লুকিয়ে রাখতাম। কেউ যদি চুরি করে দেখে ফেলে তবে তো রেহাই নেই, কান্না জুড়ে দিতাম। ঈদের দিনে বেড়ানোর মজাই আলাদা, প্রথমত বাবা-মাকে সালাম করে সালামি নেয়া পরে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে তারপর পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে। খাওয়া দাওয়ার চেয়ে বেড়ানোর আর সালামির মজাই ছিল আলাদা। সেই টাকা মাটির ব্যাংকে জমিয়ে রাখতাম। পরে কিছু কিনব। আমরা ছয় বোন পিঠাপিঠি, যে কারণে আনন্দ-উল্লাস, হইহুল্লোড় লেগেই থাকত।

সে ছিল একরাশ আলোকময় দিন : রেবেকা রহমান উদ্যোক্তা

সে ছিল একরাশ আলোকময় দিন। শলমা জরির মতো ঝলমলে। ঈদ মানে যে আনন্দ সেটা একদম শিখতে হয়নি অনুভূতি দিয়েই বুঝতে পেরেছি। ঈদের সাতসকালে বাথরুমে আম্মা নতুব সাবান দিয়ে গোসল করাতেন। তার পর নতুন গন্ধের জামা। সেই জামা তো নতুন বটেই, ঈদের আগ পর্যন্ত ট্রাংকে লুকানো থাকত। জামার পর, চুরি, ক্লিপ, স্নো, পাওডার সব দিয়ে আম্মা রেডি করে দিতেন। সবচেয়ে মজার ছিল আম্মার আঙুল দিয়ে কাজল পরানো। তার পর ফিরনি সেমাই আর বুন্দিয়া! নতুন ব্যাগে নিয়ে ছুটতাম পাড়া বেড়াতে। সন্ধ্যাবেলা ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে খুব মন খারাপ হতো। ঈস এত তাড়াতাড়ি ঈদ কেন ফুরিয়ে যায়! ভাবতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে যেতাম। এত ক্লান্ত থাকতাম। আহা সেই ঈদ আর আসে না।’

 


আরো সংবাদ



premium cement