২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমার সহজ-সরল আট পৌঢ়ে মা

মা মরিয়ম বেগমের সাথে কামাল উদ্দিন -

জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট, মনের ভেতরে যার উপলব্ধি লক্ষ করি, যার কারণে আমার অস্তিত্ব তিনি আর কেউ নন আমার জন্মদাত্রী মমতাময়ী মা। আমার মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। আমার নানা নানুর প্রথম কন্যা সন্তান তিনি, ভীষণ আদরের। যার সহজাত সুন্দর স্বভাব-চরিত্রের কারণে সবার খুবই স্নেহের পাত্রী ছিলেন। কিশোরী বয়সে আমার বাবার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ে হয়েই বিশাল সংসার এক হাতে সামলাতে সামলাতে ‘মা’ আমার যেন হাঁপিয়ে উঠতেন। কারণÑ আমার বাবা বাদশা মিঞা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তিনি রাজনীতি সমাজনীতি নিয়েই একটু বেশিই ব্যস্ত থাকতেন। মাকেই সামলাতে হতো আমার নয় ভাই-বোনের সংসার। তারপর মেহমান অতিথি তো ছিলই। এক হাতে মা কেমন করে যেন সব সামলাতেন। অবশ্য মায়ের মতো ধৈর্য ও সহনশীল নারী খুব কমই আছে।
হয়তো আমার রক্তে শিল্পের বোধগুলো সুপ্ত অবস্থায় ছিল। যেহেতু আমার জন্ম কক্সবাজার জেলার সমুদ্রসৈকত আর পাহাড় নদী প্রকৃতির অপরূপ প্রাণ-প্রাচুর্যে ঘেরা মহেশখালী এলাকায়। সুতরাং আমার হৃদয় শিল্পী হয়ে ফুটে ওঠার সুযোগ খুঁজছিল। আমার বড় ভাই সরওয়ার উদ্দিন ভালো ছবি আঁকতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তা দেখতাম, আঁকার ও চেষ্টা চালাতাম। তবে আমার স্কুলের সহপাঠী রাখাইন সম্প্রদায়ের মং নামের ছেলেটি কি-যে অপরূপ করে পাহাড়-নদী আর প্রকৃতির ছবি আঁকত, তা দেখে অবাক হয়ে যেতাম। ছোটবেলায় আমি তিন-চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন অন্তত মংদের বাসায় চলে যেতাম শুধু ওর আঁকা-আঁকি দেখতে। এমনি করে একদিন আমি নিজেই সেই নদী-পাহাড়-সবুজ প্রকৃতির একটি ছবি এঁকে মংকে সারপ্রাইজ দিলাম। মং আমার আঁকা ছবি দেখে ভীষণ অবাক হলো আর বলল ‘তুই পারবি বন্ধু তুই পারবি’ সেই থেকে পথ চলা, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি নেশার মতো ছবি আঁকতাম। মা আমার আঁকার প্রতি ঝোঁক দেখে খুশি হতেন।
ছোট্ট বেলার একটি মজার ঘটনাÑ
একদিন ঘরে একটু বড়োসড়ো কালচে রঙের একটি টিকটিকি দেয়ালে অনেকক্ষণ বসেছিল। সেই টিকটিকিটা দেখে বোনরা ভয় পাচ্ছিল। মা টিকটিকি খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমি করলাম কি, কিছুক্ষণ পর আমার সাদা অঙ্ক খাতায় সেই টিকটিকিটার একটা পেন্সিল স্কেচ করে ফেললাম।
ছবিটা মায়ের কাছে নিয়ে যেতেই তিনি এক লাফ দিয়ে উঠে বলে উঠলেনÑ ‘ফেল ফেল টিকটিকিটা’। আমি তো হেসেই শেষ। কারণ মা বুঝতেই পারেননি, এটা আমার আঁকা টিকটিকির ছবি। সেই থেকে মনে মনে স্থির করলামÑ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকা চলে আসব। মাকে সব খুলে বললাম। মা বললেন ‘খুব ভালো কথা ‘তুই তো বাবা ভালো ছবি আঁকিস সুতরাং চারুকলায় পড়তে চাইলে মন্দ হয় না।’ যেই কথা সেই কাজ। আমি ঢাকা চলে এলাম। ভর্তি হলাম চারুকলায়। এরই মধ্যে মং ডিভি ভিসা জিতে ইউএসএতে চলে গেল। ওখানেই মং আঁকিয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আজ অনেক অনেক দিন পার হয়ে গেছে ঠিক আগের মতো মায়ের কাছে যেতে পারি না। মা ও আমার ঢাকার বাসায় আসতে পারেন না। কারণ মা এখন বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন জীবনের শেষ বেলায়। মায়ের সেই হাঁক-ডাক শুনি না। কই বাবা তোরা খেতে আয় ‘আমরা নয় ভাই-বোন হই চই করতে করতে রান্না ঘরে খেতে বসতাম।’ মায়ের হাতের গরুর গোশত, ভাপা পিঠার স্বাদ আজো আমার জিভে লেগে আছে। মা মজা করে রান্না করতেন, আমি তৃপ্তি করে ভাত খেতাম। মনে হয় কত বছর মায়ের হাতের রান্না খাইনি।
ছোটবেলায় আমি কুপি (বাতি) জ্বালিয়ে ছবি আঁকতাম, পড়ালেখা করতাম। মাঝ রাতে জেগে গিয়ে মা বলতেনÑ ‘যা বাবা ঘুমিয়ে পড়, শরীর খারাপ করবে তো।’ এখন মা আমার যেন ছোট্ট শিশুর মতো হয়ে গেছে, তাকেই চলতে হয় অন্যের ওপর ভর করে। বৃদ্ধরা যেন ছোট্ট শিশুর মতো। মায়ের এ বৃদ্ধ অবস্থাটা আমি সইতে পারি না। আমার স্বাস্থ্যবতী, কর্মঠ, প্রাণচঞ্চল মা যেন নিথর পাথরের নিষ্পাপ শিশুর মতো। তার আবদার-বায়না যেন এক বছরের শিশুকেও হার মানায়। যে মা আমার নয় ভাই-বোনকে একা যতœ-আত্তি-খাওয়া-পড়া নিশ্চিত করে দিলো, আজ আমরা নয় ভাইবোন মিলেও তার একার আবদার মিটাতে হিমশিম খাচ্ছি। কারণ আমরা সবাই যার যার সংসার, জীবন ও জীবিকার সন্ধান করতেই ব্যস্ত। মায়ের খবর দিনে কতবার নিতে পারছি। ভীষণ অপরাধ বোধে বুকের ভেতরটা জ্বলে যায়। কিন্তু কিছু করার নেই। ‘মা’ তার পুরনো সংসার ছেড়ে আসতে চায় না আমাদের কাছে। এ দিকে আমরা জীবিকার কারণে সব কিছু ছেড়েও যেতে পারছি না মায়ের কাছে।
মা, ও মা, আজ আমার আঁকা ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে দেশ-বিদেশে, অনেক সম্মাননায় ভরেছে আমার ঘর। শত ছাত্রছাত্রী আমার হাতের ওপর দিয়ে শিল্পী হয়ে তৈরি হচ্ছে। আমার সবটুকু মেধা, সততা দিয়ে তৈরি করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হওয়ার চেয়ে একজন মানবিকগুণে ভরপুর সৎ মানুষ হওয়ার অনেক বেশি জরুরিÑ যেটা তুমি আমাদের শিখিয়েছ।
অনুলিখন : আঞ্জুমান আরা


আরো সংবাদ



premium cement