২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সব সময় মিথ্যা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে

-

মে-জুন মাস আসা মানে আমার মায়ের কথা বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই মনে পড়ে। কারণ সাধারণত মে মাসে পালন করা হয় মা দিবস। আর জুন মাসের ৬ তারিখে আমার মা সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। সালটি ছিল ১৯৮৪। সেই সময়ে রোজার মাস চলছি। যতদূর মনে পড়ে, মা সব রোজাই রাখতেন, আমাদের ভাইবোনদেরও রোজা পালন করার অনুপ্রেরণা দিতেন। যদিও ওই সময়ে আমি বেশ ছোট, শখ করে দুই-একটা রোজা করতাম। মা বলতেন, রোজা রেখে নামাজ, কুরআন পাঠ ইত্যাদি ধর্মীয় অনুশাসন ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারলে মহান আল্লাহ যেমন বেশি খুশি হন, তেমনি মনেও বেশি শান্তি পাওয়া যায়। সওয়াবও বেশি।
সেই সময়ে আমি একটি জায়নামাজ কিনে মাকে দেখালে মা আমার দুই গালে বেশ কয়েকটি চুমু দিয়ে হেসে ফেলেন। তার হাসি দেখে আমিও হাসতে থাকি। তা দেখে আমাদের বাসার সবাই যেমন খুশি হয়েছিল, তেমনি তারাও হাসছিল। তা দেখে পাশের বাড়ি থেকে আসা এক খালাম্মা বলেন, তোমাদের বাসায় এসে এসব দেখে ভালোই লাগছে।
মা সবসময় আমাদের বলতেন, বিনা কারণে কখনো নামাজ-রোজা কাজা করা ঠিক না। সময় সুযোগ করে বেশি বেশি নফল ইবাদত করা ভালো, বেশি বেশি দান-খয়রাত করতে হবে। আমাদের বলতেন, তোমরা সবসময় মিথ্যা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে। একটা মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে গেলে সেখানে আরো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। কেউ মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে পারলে দেখা যাবে। অনেক ধরনের অপরাধ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মিথ্যা থেকে যদি আমরা সবাই দূরে থাকতে পারি, তবে সমাজে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি ইত্যাদি এমনিতেই কমে যাবে। তাতে সমাজ হবে কলুষমুক্ত।
আমার মা নুরুন নাহার বেগম ঢাকার ওয়ারির (ফোল্ডার স্ট্রিট) ওয়ারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ফাঁকে নানা ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষাও দিতেন। আমিও ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। মা বলতেন, তোমরা কখনোই কারো মনে ব্যথা দিয়ে কোনো কথা বলো না, এ ধরনের কাজও করো না। তা করা গুনাহ। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলবে। দেখবে, মানুষ তাতে তোমাদের মিষ্টিভাষী মানুষ বলবে। শিক্ষার্থীদের নামাজ-রোজা করারও পরামর্শ দিতেন। মায়ের অনুপ্রেরণা পেয়ে অনেকেই রোজা রাখত, নামাজ পড়ত। তা শুনে অনেক খুশি হতেন মা। স্কুলে অবসরে মা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে ধর্মীয় আলাপ আলোচনা করতেন।
মা বিদ্যালয়ে নিচের শ্রেণীতে শুধু নয়, নবম-দশম শ্রেণীতেও ক্লাস নিতেন। শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে মায়ের পাঠদান শুনত। বাড়ির কাজও করত ওরা। মা স্কুলে ছুটি কাটাতেন খুবই কম। অনেক শিক্ষক মাকে বলতেন, আপা আপনি তো ছুটিই নেন না। মাঝে মধ্যে নানা কারণে ছুটির প্রয়োজন হয় না? তখন মা বলতেন, যেদিন আমি ছুটি কাটাই সেদিন আমার খুব খারাপ লাগে। তাই একেবারে প্রয়োজন না হলে ছুটি নেই না। তা ছাড়া শিশুদের নিয়ে থাকতে আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। মা ছুটি নিলে সেই ক্লাস অন্য শিক্ষক নিতে গিলে শিক্ষার্থীরা শুধু বলে, নুরুন নাহার মেডাম আজ এলেন না কেন, শরীর খারাপ করেনি তো?
বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কোনো সমস্যা দেখা দিলে সংশ্লিষ্টরা তা দূর করতে আমার মায়ের পরামর্শ নিতেন। তাতে খুব তাড়াতাড়ি সমাধান পাওয়া যেত। এ কারণে অনেকে মাকে ‘চাম্পিয়ন ম্যাডাম’ বলতেন। মা তা শুনে হাসতেন আর বলতেন, এত বেশি বাড়িয়ে বলার দরকার কী? এতে আমি লজ্জাবোধ করি।
আমাদের বাসায় কোনো অতিথি বা প্রতিবেশী এলে মা তাদের নানারকম খাবার জিনিস দিয়ে আপ্যায়ন না করা পর্যন্ত শান্তি পেতেন না। আম, চালতা, জলপাই, পেঁয়াজ, করমচা, রসুন, তেঁতুল ইত্যাদির আচার বানিয়ে শোকেসে থরে থরে সাজিয়ে রাখতেন। আম, কুমড়া, পেঁপে ইত্যাদি দিয়ে মোরব্বাও বানিয়ে রাখতেন। কেউ বেড়াতে এলে বিশ্রামের পর তাদের এসবের জায়গায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, আপনাদের কোনটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
অতপর তাদের ইচ্ছার খাবারই খেতে দিতেন।
বিকেলের দিকে আমার মা যাত্রাবাড়ীতেই (ঢাকার) একটি সেলাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেখানেও মা সবার সাথে মিশেমিশে সেলাইর কাজ করতেন ও করাতেন। মাঝে মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও নিতেন। আরো অনেক ধরনের কাজ করতেন আমার মা। তাই বলতে হয়, নিজের সংসারের (আট সদস্যের) সব কাজ ঠিকমতো করে একাধিক পেশাগত কাজও সফলভাবে করতেন। আমাদের পড়ার জন্য কোনো শিক্ষক না এনে নিজেই পড়াতেন। তা দেখে সবাই বলতেন, মাস্টার আপার ছেলেমেয়েরা আপার কাছে পড়বে এটাই তো ভালো। তাতে কমবেশি অর্থ সাশ্রয় হয়।
মা তার চাকরির বেতনের টাকার পুরোটাই বাবার হাতে তুলে দিতেন। বাবাও তার বেতনের টাকা মায়ের টাকার সাথে একসাথে করে ভালো করে গুনে রাখতেন। আমরা তাদের কখনোই কোনো ধরনের অপব্যয় বা অর্থ-অপচয় করতে দেখিনি। আর সে কারণেই হয়তো যাত্রাবাড়ীতে অনেক আগেই আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। এখনো অনেকে আমার মায়ের প্রশংসা করে প্রায় কেঁদেই ফেলেন এবং বলেন, এই জামানায় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক।

 


আরো সংবাদ



premium cement
ফিলিপাইনে ব্রহ্মস পাঠাল ভারত, ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি চীনের মোকাবেলায় নতুন ডিভিশন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে! আবারো চেন্নাইয়ের হার, ম্লান মোস্তাফিজ 'কেএনএফ' সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা অর্থনীতিতে চুরি : ব্যাংকে ডাকাতি পাকিস্তানে আফগান তালেবান আলেম নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য না করলে এ বছরই রাশিয়ার কাছে হারতে পারে ইউক্রেন : সিআইএ প্রধান রাশিয়ার সামরিক শিল্পক্ষেত্রে প্রধান যোগানদার চীন : ব্লিংকন ইরাকে সামরিক ঘাঁটিতে 'বিকট বিস্ফোরণ' শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার

সকল