২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পথ হোক নিরাপদ

-

১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার ফার্মগেট থেকে দোতলা বাসে উঠি, যাত্রা উত্তরা ভাইয়ের বাসায়। রাস্তায় জ্যাম আছে মোটামুটি, বাসটা কাকলি এলেই হেলপার নেমে যান। ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে আসা একটা একটা করে গাড়িগুলোকে হাতের ইশারায় আস্তে আস্তে থামান। এ দিকে ড্রাইভার গাড়িটি বামসাইড করেন। দোকানের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা ২০-২৫ জন শিক্ষার্থীকে পথ বের করে দিয়ে হেলপার বাসে তোলেন। (সবাই শহীদ বীর উত্তম আনোয়ার গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী, একসময় এই কলেজে আমার বড় মেয়েও পড়ত) আমি আর ছোট মেয়ে সামনের দরজার প্রথম সিটেই বসা। বাসে ২-৪ সিট খালি ছিল, সব শিক্ষার্থী উঠে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি এই ২০-২৫ জন সবাই ভাড়া দিবে, যে বাসে উঠবে সেখানেই ভাড়া দিবে। কিন্তু ওদের বাসে তোলার জন্য ড্রাইভার বা হেলপার যে মানবতা দেখাল তাতেই আমি খুশি। আসলে এটাই হওয়া উচিত প্রতিটা ক্ষেত্রে। ঘটনা এখানেই থেমে যায়নি। অনেক শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে দেখে হেলপার সামনের দরজা দিয়ে আর কোনো পুরুষযাত্রী তোলেননি। মহিলাদের সামনের দরজা দিয়ে আর পুরুষদের পেছনের দরজা দিয়ে তুলেছেন আর নামিয়েছেন। সত্যিই হেলপারের এমন মনোভাব দেখে আমি আনন্দিত, সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম আপনার নাম কি? বললেন, ‘মোহাম্মদ জাবেদ’। জাবেদ ভাই আপনার মতো অন্যরা যদি হতো আমার, আর আমার মা বোন সন্তানদের চলার পথ সব সময় নিরাপদ থাকত।
মিরপুর থেকে ফিরছি তখন বেলা ১টা। বাসে অনেক সিট খালি, উঠেই দেখি গেটের বাম পাশের সিটে একটা মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসা, পাশে একটা লোক। দেখেই বুঝতে পাড়ি ওরা একসাথের নয় লোকটাকে বলি,
Ñআপনি কি ওর সাথে?
Ñনা।
Ñএত সিট খালি তবুও মেয়েটার পাশের সিটে বসার ইচ্ছে হলো, যান ওই সিটে বসেন।
লোকটাকে উঠিয়ে দিয়ে আমি বসি মেয়েটার পাশে। মেয়েটা জানায়, লোকটা উঠেই ওর দিকে চাপতে থাকে।
গ্রিনরোড থেকে রিকাশায় এসে নেমেছি ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে, সাথে ছোট মেয়ে। গন্তব্য ফার্মভিও মার্কেটে। হলের সামনের বাটার দোকানের সামনে দিয়ে আসছি আমরা, ফুটপাথে ভিড় আছে মোটামুটি। হঠাৎ ৩০-৩২ বয়সী একটা লোক মেয়ের হাতের কবজি ধরে ওকে সরিয়ে দেয়। আমি দেখেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করি-
বিষয়টা কি?
মা বুঝলাম না।
হয়তো লোকটার তাড়া ছিল তাই এমন করে সরিয়ে দিয়েছে। ওকে কথাটা বলেই আমি পেছনে তাকাই, দেখি লোকটা বাটার দোকানে ঢুকে সামনে থাকা সেন্ডেল হাতে নিয়ে চোখ পিটপিট করে আমায় দেখছে। তখনি আমার মাথাটা বিগড়ে যায়। বলে রাখি আমি রাস্তায় চলতে খুব সাবধানে চলি, চারপাশ লক্ষ রেখেই চলি। আর সন্তানরা বা তাদের বন্ধুরা সাথে থাকলে আরো সচেতন থাকি।
আমি পেছনে গিয়ে লোকটার পাশে দাঁড়াই। বলি -
বিষয়টা কি?
কোন বিষয়?
মেয়েকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে কেন?
কই না তো।
তখন চারপাশের লোকগুলো এ দিকে মনোযোগী হলেন। লোকটাকে বললাম-
না যদি হয়, তাহলে সেন্ডেলের দোকানে এসে সেন্ডেল হাতে আমায় দেখছিলে কেন?
এমনিতেই।
ওই বদমাইশ তুই আমারে যা বুঝাবি আমি কি তাই বুঝবো। আমি তো ধরেই নিয়েছি তোর ব্যস্ততা ছিল, তাই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে। কিন্তু যখন দেখলাম তুই আমাকে আবার আড় চোখে দেখছিস তখনই বুঝে গেছি তুই ইচ্ছা করেই ধাক্কা দিয়েছিস।
বাধ্য হয়ে সে ক্ষমা চেয়ে বিদায় হলো।
নিজের ব্যক্তিগত কাজে ফার্মগেট থেকে যেতে হয় মিরপুর এক নম্বরে। ফার্মগেট থেকে চিড়িয়াখানার বাসে উঠি। খালি সিট পেয়ে বসি, আসাদ গেট যেতেই বয়স্ক এক মা উঠলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে ওনাকে বসতে দেই। আমি মনে করি এটা আমার কর্তব্য। সামান্য এগিয়ে গেলেই খালি সিট পেয়ে আমি বসি। বাইরে তাকিয়ে দেখি এক লোক হাত নাড়ছে বাসে উঠবে, সাথে মহিলা আর কোলে ১২-১৩ মাসের শিশু। হেলপার উঠাবে না, ওকে উঠাতে বলি, সে জবাব দেয় উঠলেই খালি সিট চাইবে। আমি বলি, চাইবে না, তুমি উঠাও, নিশ্চই জরুরি।
গাড়ি সামান্য ধীর করতেই ওরা ওঠে, উঠতে গিয়ে মহিলার এক পা পড়ে যায়। প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই তাকে গাড়িতে উঠতে হয়। উঠার পর দেখি মহিলার কনুই ছিলে গেছে। লোকটার কোলে শিশুটা ঘুমে। শিশুটাকে আমার কোলে দিতে বলি। তাই দেয়। টেকনিক্যাল আসার পর ওরা সিট পায়, শিশুটাকে নিয়ে নেয়। জানতে পারি শিশুটাকে নিয়ে মিরপুর দুই নম্বর হার্ট ফাউন্ডেশন যাচ্ছেন।
কলেজ গেট পার হয়ে দেখি রাস্তার দুই পাশে সাদা পোশাকের অনেক কলেজছাত্রী, সাথে অভিভাবকরা। বুঝতে পারি এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেসিডেন্সিয়াল কলেজে সিট, পড়ে হলিক্রস কলেজসহ আরো অনেক কলেজের। এই বাস ফার্মগেট যাবে বলে অনেক ছাত্রী এগিয়ে আসে, বাস জ্যামে থাকায় ওরা উঠতে শুরু করে, সাথে কারো মা, কারো বাবা। বাসটা রাস্তার বাম পাশেই ছিল, গেটে হেলপার নেই, সে ভাড়া কাটতে ভেতরে গেছে। ড্রাইভার গেটের দিকে না তাকিয়েই গাড়ি টান দেয়। বাবা-মাসহ মেয়েরা অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সামান্য চার-পাঁচ হাত সামনে গিয়ে আবার গাড়ি জ্যামের জন্য দাঁড়ায়। কয়েকটা মেয়ে উঠার পর তাদের মা-বাবাও ওঠেন। গেটে হেলপার নেই, একটি মেয়ের বাবাকে আমি বলি,
আপনি দুই পাশে হাত দিয়ে গেট আটকে ধরেন, তাহলে ওদের জন্য ভালো হবে।
উনি তাই করেন। ওদের হাতে থাকা খাবার পানির ফ্লাক্স আমি হাতে নিয়ে বসি। কয়েকটা মেয়ে ওদের প্রবেশপত্রের ফাইল আমার কাছে দেয়। এখানে প্রশ্ন হলোÑ
গেট ছেড়ে হেলপার কেন ভেতরে? কেন ভাড়া কাটতে কনডাক্টর নেই? কেন বাস ড্রাইভার গেটের দিকে না তাকিয়েই গাড়ি টান দিলো? কেন অভিভাবককে হেলপারের দায়িত্ব পালন করতে হবে? তবে কি এসব দেখার কেউ নেই? আমাদের নিরাপদ পথ কোথায়? আর কত দূর?


আরো সংবাদ



premium cement