প্রতিবন্ধকতা হারাতে পারেনি দুই তরুণীকে
- নিয়ামুর রশিদ শিহাব
- ০৬ মে ২০১৯, ০০:০০
আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকলে দমাতে পারে না কোনো প্রতিবন্ধকতা। শত বাধা-বিপত্তিতেও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া যায় স্বপ্ন পূরণের পথে। এমনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার দুই তরুণী। তারা হলেন পৌরসভার বাসিন্দা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাল্গুনী সাহা ও কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণকলস গ্রামের খারিজ্জমা কলেজের ২০১৯-এর এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমা আক্তার।
জানা গেছে, গলাচিপা পৌরসভার বটতলা এলাকার জগদীশ চন্দ্র সাহা ও ভারতী রানী দম্পতির সন্তান ফাল্গুনী। চার ভাইবোনের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। জন্মটা ছিল অন্য সব পরিপূর্ণ শিশুর মতো। বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান ফাল্গুনীর দুই চোখ ভরা ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল এক দুর্ঘটনা। ২০০২ সাল যখন ফাল্গুনীর বয়স মাত্র দুই বছর। একদিন ফাল্গুনী তার বোনের সাথে কাপড় শুকাতে পাশের বাড়ির ছাদে যায়। দুরন্ত শিশুসুলভ আচরণে ফাল্গুনী খেলা করতে থাকে ছাদে। একপর্যায়ে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়াতে গিয়ে পাশের বিদ্যুৎ লাইনের সাথে তার দুটি হাত জড়িয়ে যায়। আর্তচিৎকারে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বিদ্যুতের তারে জড়ানো অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। এ সময় তার দু’হাতের কবজি মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। পুড়ে যাওয়া দুই হাত নিয়ে তাকে প্রথমে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার দিন থাকাকালীন ডাক্তারদের চরম অবহেলার কারণে তার দুই হাতের ক্ষততেই পচন ধরে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় ১১ দিনও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার সঞ্চয়ের কিছু টাকা নিয়ে রওনা হয় ভারতের উদ্দেশে। তবুও শেষ পর্যন্ত রাখা যায়নি হাত দুটো। পচন ধরে যাওয়ায় কবজিসহ কেটে ফেলা হয় দুই হাত। তিনি চিরদিনের মতো হয়ে যায় প্রতিবন্ধী। তবুও তার আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে যায় পড়ালেখা। ফাল্গুনীর প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে পঙ্গুত্ব। ২০০৫ সালে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে এবং এসএসসি গলাচিপা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়াশোনা করছে। ভবিষ্যৎ জীবনে পড়ালেখা শেষ করে বৃদ্ধ মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হতে চান একজন বিসিএস কর্মকর্তা। এ জন্য তিনি সবার সাহায্য ও দোয়া কামনা করেছেন।
অন্য দিকে, গলাচিপা উপজেলার কলগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণকলস গ্রামের মো: ইউসুফ হাওলাদার ও মাজেদা বেগমের তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে লিমা সবার ছোট। জন্ম থেকেই লিমার পা দুটো উল্টোভাবে ভাঁজ হয়ে আছে। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। মা ও মেজ বোন সাবিনা তার প্রাত্যহিক কাজের সঙ্গী। পড়াশোনা করতে পারার পেছনে পরিবারের মানুষগুলো, শিক্ষক ও বন্ধুদের অবদানও কোনো অংশে কম নয় বলে জানান লিমা। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। তবুও নিজের প্রবল ইচ্ছায় ও একই গ্রামের অজয় স্যারের সহযোগিতায় লিমা ভর্তি হয়েছিল বাঁশবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইভেট পড়া ছাড়াই ২০১৭ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৩.৬৪ পেয়েছে। চলমান এইচএসসি পরীক্ষা খারিজ্জমা ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে পরীক্ষা দিচ্ছেন লিমা। এবার আরো ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশা লিমার। এত দূর পথ পাড়ি দেয়ার পথে ছিল নানা বাধা-বিপত্তি। দুই হাঁটুতে ভর করে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে এক বিরাট সাঁকো পার হয়ে প্রতিদিন যেতেন কলেজে। ছিল না কোনো হুইল চেয়ার কেনার সামর্থ্য। তবুও তিনি সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছেন আলোর পথে। একসময় লিমার ব্যাপারটি নজরে আসে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের। তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর এগিয়ে আসেন অনেকেই। গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ মো: আখতার মোর্শেদ লিমাকে একটি হুইল চেয়ার দেন। উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম ফরম পূরণের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকেও পেয়ে থাকেন নানা ধরনের সহায়তা। এ জন্য লিমা সবার কাছে কৃতজ্ঞ। এখন তার স্বপ্ন আরো সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাই তিনি সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন। এভাবেই সবাই এগিয়ে এলে প্রতিবন্ধীরাও পারে তাদের ভেতর লুকানো স্বপ্ন ও প্রতিভা বাস্তবে রূপ দিতে। সমাজের বিত্তবান লোকেরা এগিয়ে এলেই সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব।