১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ভিন দেশ

ব্যর্থতা থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে : দেবরা ইফরমসন

-

ফরাসি, ইংরেজি, ভিয়েতনামিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা যার দখলে তিনি হলেন মার্কিন নারী দেবরা ইফরমসন। আমাদের জন্য যেটা খুশির খবর সেটা হলো এসব ভাষার মধ্যে বাংলাই তার বেশি দখলে। বুঝতে দেরি হওয়ার কথা নয় আমাদের, যা হলো দেবরা ইফরমসন ‘বাংলাপ্রীতি’ নারী। কেননা তিনি নিজেই বলেছেন, সবচেয়ে ছন্দময় ভাষা হচ্ছে বাংলা। এমন সুন্দর মন্তব্য করার কারণ আছে। তিনি জড়তাহীনভাবে নিখুঁত বাংলা বলেন। খোদ বাঙালিরাই যা দেখে ও শুনে অবাক হন। সামাজিক মাধ্যমেও বিশ্বের মানুষ তা দেখছে। যে কারণে বাংলাভাষীদের কাছেও দেবরা প্রিয় হয়ে গেছেন। দেবরা বলেন, ‘বিশ্বের যেখানেই যাই, আমার আসার কথা শুনে সেখানকার বাঙালিরা ছুটে আসে আমাকে দেখতে ও আমার কথা শুনতে। বিষয়টি আমারও খুব ভালো লাগে। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমি অনেক বাঙালির হৃদয়ে বাংলার ভাবনা বা কদর জাগিয়ে তুলতে পেরেছি। যদিও এখনো বাংলা ভাষার ব্যাপারে যথেষ্ট অনীহা ও অবহেলা রয়েছে বাংলাভাষীদের কাছে। বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে তিনি তার কৌশলের কথা বলেন, তিনি বলেন, আমি (দেবরা) বাংলা ভাষা শেখার শুরুতে বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত নিই, বাংলা ভালো বলতে ও লিখতে পারে এমন মানুষের কাছ থেকে শিখলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। ছোট ছোট বাক্য শেখার মাধ্যমেই তিনি সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন সফলভাবে। যে কারণে এখন তিনি বাংলা বলেন মিশ্রণমুক্তভাবে। এখন তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদিও পড়েন।
দেবরা ইফরমসন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন ১৯৯৪ সালের দিকে। নিজ দেশে ফিরে গিয়ে কয়েক বছর পর আবারো আসেন বাংলাদেশে। পরিচয় হয় বাংলাদেশী এক তরুণ সাইফুদ্দিন আহমেদের সাথে। এই তরুণের কাছ থেকেও বাংলা শিখতে থাকেন দেবরা। পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় তারা বিয়েও করেন। দেবরা বলেন, ‘বাংলা শেখার ব্যাপারে আমি আমার স্বামীর সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি।’ বাংলাদেশের শাকসবজি, খিচুড়ি, ভর্তা ইত্যাদিও খেতে পছন্দ করেন তিনি।
দেবরা কানাডার হেলথ ব্রিজ নামক এনজিওর আঞ্চলিক পরিচালক। ১৯৯৪ সাল থেকে এশিয়ায় বসবাস করে স্বাস্থ্য, তামাক নিয়ন্ত্রণ, লিঙ্গ বিষয় এবং বাসযোগ্য শহর-সংক্রান্ত কাজ করছেন। তিনি স্থানীয় এনজিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকায় বাংলাদেশের অধিকতর উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন। এমনকি স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতি বিষয়ে লেখালেখি করেন ও কথা বলেন। ২০১৫ সালে ‘বিয়ন্ড এপোলজিস্ট’ নামক একটি বই লিখেন, সেখানে তুলে ধরা হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তিসংক্রান্ত নানা বিষয়।
শহর সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল, শহর হচ্ছে ময়লা ও দূষিত স্থান। কিন্তু তিনি যখন জনৈকি রিচার্ড রেজিস্টার্সের কাছে শহরভিত্তিক বইখানা পড়েন, তখন তার ধারণা পাল্টে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস বা ক্ষতি না করেও আমাদের সৃষ্টি শহরগুলোকে রক্ষা বা হেফাজত করা যায়। প্রকৃতিতে আছে কিন্তু উদ্ধার হয়নি এমন সম্ভাবনাময় বিষয়ও রয়েছে। যদিও কোথাও কোথাও তা উদ্ধার হয়ে থাকতে পারে।
তিনি মনে করেন, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সাথে শহরের রূপরেখা নির্ধারণ করা উচিত। ‘আমার কাজে আমি দৃষ্টি দেই প্রধানত পরিবহন ও পাবলিক প্লেসের ওপর। আমি শহরে কৃষি, পানি এবং প্রকৃতিবান্ধব পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। অর্থনীতি সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যা ইকোসিটির দিকে আমাদেরকে এগিয়ে নেয় নাকি বাধা দেয়’Ñ এসব কথাও বলেছেন দেবরা ইফরমসন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার কর্মক্রিয়া সম্বন্ধে ব্যাপক আলোচনা করতে আগ্রহী। প্রচুর লোকের বসবাসের এ জায়গাটি নিয়ে কাজ করে ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে চান। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত নানা কাজ আমাকে শিক্ষা দিয়েছে কিভাবে ইকোসিটি তৈরির পলিসি প্রণয়ন করতে হয়। আমি কৃতকার্যতার কিছু বিষয় দেখাতে চাই, যে শহর বসবাসের ক্ষেত্রে খুবই নি¤œতম অবস্থানে রয়েছে, সেই শহরেরও ভালো দিক আছে বিশ্বকে দেখানোর জন্য।
ইকোসিটি ওয়ার্ল্ড সামিট ’১৫ থেকে আপনি কী শেখাবেন বলে আশা করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে দেবরা বলেন, এ ধরনের প্রতিটি সামিটে অংশ নিয়ে আমি অনেক নতুন বিষয় জানার সুযোগ পেয়েছি। যেসব জায়গায় আমি কাজ করিনি, সেসব জায়গারও ইকোসেনিটেশন, পানি, কৃষি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি। তিনি সব সময় জনগণকে উৎসাহ প্রদানের জন্য এবং তাদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য জোর চেষ্টা চালান। এসব কাজে পারদর্শী, এমন কাউকে খুঁজতেন। যাদের মাধ্যমে ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি থেকে অনেক কিছু শিখতেও আশা করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব জ্ঞান দিয়ে আমি অধিকতর সম্ভাবনা ও সহযোগিতা সৃষ্টির জন্য সচেষ্ট ছিলাম।
ইকোসিটি সম্বন্ধে দেবরা বলেন, একটি শহরের ভূপৃষ্ঠে দাঁড়িয়েই ইকোসিটি বোঝা যায় না। কিন্তু ঢাকায় এ সংক্রান্ত অনেক উপাদান আছে। একটি উপাদান হলো এখানকার সাইকেল-রিকশার উপস্থিতি এবং এখানকার যাতায়াত মানে হাঁটা। তবে এখনো এখানে কিছু জলাশয়, পার্ক, গাছপালা ইত্যাদি আছে। আরো আছে অঘোষিত অর্থনীতি, বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর লোক রাস্তায় বসে বিভিন্ন ধরনের জিনিস বিক্রি করে, যা একটি কৌতুকপূর্ণ আবহেরও জন্ম দেয়। কিছু লোক দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী। কারণ, ঢাকা শহরে ভবনের ঘনত্ব বেশি। বেশির ভাগ লোক ব্যক্তিগত গাড়ি রাখার সক্ষমতা রাখে না। ক্রমে একটি যতœহীন শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান শহরের মতো নয়। ক্রমবর্ধমান শহর মানে যেখানে আরামে হেঁটে বা যানবাহনে গন্তব্যে পৌঁছা যায়।
ইকোসিটিজেনশিপ সম্পর্কে দেবরা বলেন, আমাদের পরিবর্তনের জন্য এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, সবাইকেই কাজ করতে হবে। আমার লেখা ‘বিয়ন্ড এপোলজিস্ট’ নামক বইতে এসংক্রান্ত অনেক কথা আছে। একজন ইকোসিটিজেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্ব বোঝেন। এ ক্ষেত্রে অধিকতর পার্থিব সম্পদ, আরাম-আয়েশ ইত্যাদি যা-ই থাকুক; তার সাথে আমরা পরিবেশের খাতিরে আপস করতে পারি না। একজন ইকোসিটিজেন এই বিশ্বাসের ওপর কাজ করেন যে, অপরকে উৎসাহ দেয়া এবং নীতিনির্ধারকদের ঝাঁকুনি দেয়া, যাতে এমন সিদ্ধান্ত হয় যা জনগণ, পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকূল। একজন ইকোসিটিজেন নীতিনির্ধারকদের কাছে চিঠি লিখেন, আন্দোলনে যোগ দেন, কথা বলেন বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সাথে, একযোগে কাজ করতে হবে জনগণ ও পরিবেশের উন্নয়নের জন্য। যা কোনো প্রকার লাভ বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নয়। যেসব যুবক তাদের শহর ও প্রতিবেশকে পরিবেশগত ও সামাজিকভাবে আরো শক্তিশালী করতে চায় তাদের জন্য বলেন, কাজ পরিচালনা করবে এমন কারো জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। সমস্যাটি নিজেকেই দেখতে হবে এবং সমাধানের জন্য কাজে লেগে যেতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে যদি কাউকে না পাওয়া যায় তবে নিজেকেই লেগে যেতে হবে। অর্থাৎ হাল ছাড়া যাবে না। এমনকি ব্যর্থতা থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। একসাথে কাজ করে আমরা অবশ্যই অধিকতর সুন্দর পৃথিবী গড়তে পারব।


আরো সংবাদ



premium cement