২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অটিস্টিক শিশু ও তাদের মায়েরা

-

দীর্ঘ পাঁচ-সাত বছরের পরিচয় তিথি ও যূথীর আম্মুর সাথে। পাশাপাশি স্কুলে আমাদের সন্তানেরা। বছরখানেক হলো পাশের ভবনের তিনতলায় আসে তিথিরা। দুই ভবনের তিনতলায় থাকি বলে কথা হয়। প্রায়ই ওদের বাসা থেকে একটা কান্নার শব্দ পাই। বারান্দায় ছোট ছোট কাঁথা নাড়তে দেখি। জানা মতে ওদের বাসায় ছোট শিশু নেই। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাবী, ছোট শিশুর কাঁথাÑ বাবু এসেছে নাকি?’
‘না, মানে আমার একটা বড় ছেলে আছে ও অটিজমে আক্রান্ত শিশু।’
ছোট মেয়ে অভ্রের সাথেই প্লে ক্লাসে ভর্তি হয় নাবিলা, ও অন্য সব শিশুর মতো নয়। একটু দুষ্ট আর যখন তখন অন্য শিশুদের সাথে লেগে যায়, সবাই বোঝে নাবিলা অটিস্টিক শিশু। অভিযোগের কারণে নাবিলাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় ওর মা। অটিজম স্কুলে দেয়, নাবিলা আরো আক্রান্ত হয়। ওর মায়ের কথা, ‘সাধারণ শিশুদের স্কুলে থেকে নাবিলা সুস্থ হচ্ছিল, অটিজম স্কুলে নেয়ার পর ও আরো অসুস্থ হয়। পাঁচ-ছয় বছর পর দেখা নাবিলাকে, ও পুরোই প্রতিবন্ধী মানসিক ও শারীরিকভাবে।
রিয়ন ওর মা-বাবার একমাত্র সন্তান, জন্মের দেড় বছরের মাথায় ওরা বুঝতে পারে রিয়ন স্বাভাবিক শিশু নয়, অটিজমে আক্রান্ত। রিয়নকে নিয়েই কাটিয়ে দেয় ওর বাবা-মা। আবার কেন সন্তান নেননি জিজ্ঞেস করায় রিয়নের মায়ের কথা, ‘আরেকটা সন্তান নিলে রিয়নকে দেখাশোনা করতে সমস্যা হবে, আর সেই সন্তানও যদি এমন হয়, তাই ওকে নিয়েই আছি আমরা। আগে জব করতাম, এখন জব করলে ওকে দেখবে কে, তাই জব ছেড়ে দিয়েছি।’
বর্তমানে মোট ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৬০৮ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছে যাদের মধ্যে ৪৭ হাজার ৪১৭ জন রয়েছে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি। ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, গ্রামের চেয়ে শহরে অটিজমবিশিষ্ট শিশুর সংখ্যা বেশি। প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ শিশু অটিজমে আক্রান্ত। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন বা প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪ জন। শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু, যা প্রতি হাজারে ২ দশমিক ৫ জন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। মেয়েশিশুর চেয়ে ছেলেশিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। সেই হিসাবে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭ জন।
২ এপ্রিল পালিত হলো ১২তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ও অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার’। অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হচ্ছে।
তিনটি পরিবারের ঘটনা আলাদা, মিল একটাই তিনটি পরিবারে অটিজম শিশু রয়েছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা আর ১০টা স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়। তাদের সীমাবদ্ধতা মানসিক ও শারীরিক। অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। এখনো আমাদের বেশির ভাগ পরিবার পুরুষের আয়ের ওপরে চলে। এতে বাবারা দিনের বেশি সময় বাইরে থাকে। মায়েদেরই থাকতে হয় সন্তানের সাথে। একটি অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রেও তাই। মা তাকে সময় দেন মা তার সাথে চলাফেরা করেন। এতে সমাজের কটূক্তি বা অস্বাভাবিক আচরণ মাকেই দেখতে হচ্ছে। খুব কাছ থেকেই এই তিনজন মাকে আমি দেখেছি। একজন সমাজের ভয়ে বা বিভিন্ন কথা শুনার ভয়ে ঘরে অটিজম সন্তানের কথা কাউকে বলেন না। শত দুঃখকষ্ট তারা নিজেরাই বুকে চেপে রাখেন। আরেক মা সন্তানের কথা ভেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এই সন্তানের ওপর অযতœ হবে ভেবে আর সন্তানই নিচ্ছেন না। অন্য মা তার সন্তান নিয়ে এই স্কুল ও স্কুল করছেন। আসলে মায়ের কোনো তুলনা হয় না। মা শুধু মা-ই। তার পরও অনেক পরিবার অটিজম শিশুদের তালিকায় নিজের সন্তানের নাম দিতে চান না। এতে অনেক অটিজম আক্রান্ত শিশু অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদ্যোগ নিতে হবে যাতে অটিজম আক্রান্ত সব শিশুই তাদের অধিকার পায়। তাদের মায়েরা থাকে স্বস্তিতে।
আমরা চাই এই বিশেষ শিশুরা সব শিশুর মতো বিশেষ দিনে বা অন্য দিনগুলোতে সবার সাথে আনন্দ করে কাটিয়ে দিক। পরিবার যেন ওদের সব সময়ের জন্য বন্দী করে না রাখে।


আরো সংবাদ



premium cement