মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চান মোকাররেমা খাতুন
- শওকত আলী রতন
- ২৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০
মোকাররেমা খাতুুন, বর্তমানে বয়স ৮৫ বছর। মোকাররেমা খাতুনের স্বামী প্রয়াত সেরাজ উদ্দিন আহমেদ। সেরাজ উদ্দিন আহমেদ ২০০৫ সালে ইহকাল ত্যাগ করেন। তিনি তৎকালীন দোহার থানা মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়ার কারণে পাকিস্তানি দোসররা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। সে এক দুঃসহ সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন মোকাররেমা খাতুন। সেই দিনের কথা মনে পড়লেই হঠাৎ আঁতকে ওঠেন। ভয়াবহ সেই সময়ের কথা তার মুখেই শুনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। চার দিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। দেশকে ও দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি চলছে। যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য চলছে যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমিটি। ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকার দোহার উপজেলার থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পান আমার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত বিমানবাহিনীর ফ্লাইট সার্জেন্ট সেরাজ উদ্দিন আহমেদ। তার আগে থেকেই বাঙালিরা যখন বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ বেধে যাবে, তখন থেকে দোহার উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বয়সের দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী মানুষ নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন আমাদের বাড়িতে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হতো। এদের মধ্যে অনেকেই এই বাড়িতে রাত যাপন করতেন। তাদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করতেন সেরাজ উদ্দিন আহমেদ। এ খবর যখন পাক হানাদার বাহিনী জানতে পারে, তখন থেকেই সেরাজ উদ্দিন আহমেদকে ধরে আনার জন্য বাড়িতে বারবার হানা দেয় পাকবাহিনী। তখন থেকে সেরাজ উদ্দিন গা-ঢাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন। তার অবর্তমানে স্ত্রী মোকাররেমা খাতুন পাঁচ সন্তান নিয়ে দুঃসহ দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন পার করেন। প্রতিদিন অনেক মানুষের রান্নার জোগাড় করতে হতো। অন্তত বড় এক ডেক ভাত ও তরকারি রান্নার আয়োজন করতে হতো তাদের। সহযোগিতার জন্য পাশের গ্রামের আসমত বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন। পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে ওই সময় কেউ স্থানীয় পালামগঞ্জ বাজারে যেতে সাহস করত না। সেখানে প্রায়সময়ই অবস্থান করত হানাদার বাহিনী। আমাদের বাড়িতে প্রচুর শাকসবজি হতো, হাঁস-মুরগির ডিম উৎপাদন হতো; তা দিয়েই চলত প্রতিদিনের খাবার। এভাবেই কেটেছে প্রায় দুই মাস। একটা সময় পাকিস্তানিদের আমাদের প্রতি আক্রোশ বেড়ে গেল তখন আমার স্বামী বাড়ি এসে বলে গেলেন, ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে কোনো ধরনের বিপদ দেখলে নৌকা দিয়ে নিরাপদে চলে যাবে। সেদিন থেকেই আমি আর বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি। সব সময় প্রস্তুত থাকতাম এই বুঝি পাকিস্তানি মিলিটারি আক্রমণ করার জন্য আসছে। এমন ভয়ের মধ্যে কাটত সারাক্ষণ। সে সময় ছিল বর্ষাকাল। পালামগঞ্জ খাল দিয়ে আমাদের বাড়ির একমাত্র রাস্তা ছিল। এ জন্য সব সময়ই কোনো-না-কোনো মুক্তিযোদ্ধা পালামগঞ্জ বাজারের আশপাশে অবস্থান নিয়ে হানাদার বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করতেন। যখনই জানতে পারতাম পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের বাড়ির দিকে আসছে, তাৎক্ষণিক আমি আমার পাঁচ সন্তান নিয়ে দ্রুত বাড়ি ত্যাগ করতাম। অন্যত্র ছুটে যাওয়ার সময়ও মনে হতো, এই বুঝি আমাদের পাকিস্তানি বাহিনী ধরে ফেলল। তখন আমার বড় ছেলে হিসাম উদ্দিনের বয়স ছিল ১৪ বছর। হিসাম একটু-আধটু বুঝলেও অন্যরা সবাই ছিল অবুঝ। পাঁচ সন্তানকে সামলে রাখা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সারা দিন পালিয়ে থাকার পর রাতের বেলা থাকতাম বাড়িতেই, কিন্তু নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো। সারাক্ষণ সন্তানদের চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। আবার আমার স্বামী কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করায় তাকে নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তায় থাকতাম। তার পর একটা সময় দেখলাম আর বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়, তখন চলে গেলাম পাশের উপজেলা নবাবগঞ্জের কোমরগঞ্জে আমার খালার বাড়িতে। সেখানেও হানাদার বাহিনীর লোকজন আমাদের অবস্থান জানতে পারায় আমরা চলে যাই আমার নানার বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বলড়া গ্রামে। সেখানে অবস্থানকালে জানতে পারি, আমাদের রাইপাড়া গ্রামের বাড়ির বড় বড় পাঁচটি ঘর পাক বাহিনী জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন বাড়িতে আসার জন্য মনকে কোনোভাবেই মানাতে পারছিলাম না, সবাই সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছিল। ঘরের মূল্যবান অনেক আসবাব ছিল, সেগুলো লুটপাট করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের বলড়া গ্রামেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তুমুল যুদ্ধ শুরু করে। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সেখান থেকে ১ কিলোমিটার অদূরে বাংকার বানিয়ে মুহুর্মুহু গুলি চালায়। গুলির শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। একটা সময় পর জানতে পারলাম, দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছে। তখন বাড়ি এসে দেখি, ঘরগুলো কোনো রকম খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ওই সময় থাকার মতো কোনো ঘর ছিল না। যখন প্রতিবেশী নুরুউদ্দিন কাকা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের বাড়িঘর ঠিকঠাক করে আমাদের বাড়িতে উঠি। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে এসে সহমর্মিতা জানান। এখনো আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আসা-যাওয়া করেন। মোকাররেমা খাতুন আক্ষেপের সাথে জানান, দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধের সময় আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পূরণের জন্য কোনো সরকারই এগিয়ে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আগুনে পোড়া একটি ঘর স্মৃতি হিসেবে রয়েছে, যেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। মোকাররেমা খাতুনের দগদগে ক্ষত নিয়ে কাটে প্রতিটি দিনরাত্রি। কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। তিনি জানান, একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান পাই, সেই সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।