১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেয়েরা নিজেরাই উন্নতি করছে অনেক : ড. নাসিমা আক্তার, নির্বাহী পরিচালক (বাংলাদেশী কানাডিয়ান কমিউনিটি সার্ভিসেস টরেন্টো, কানাডা)

-


ড. নাসিমা আক্তার। অত্যন্ত মেধাবী এ মানুষটির ছোটবেলা কাটে নিজ জেলা কুমিল্লার মুরাদনগর থানার রাজবাড়ী গ্রামে।
নাসিমা মা-বাবার চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নাসিমার বাবা আদমজী জুট মিলে যোগদান করেন। গণি ভূঞা আদমজীতে বসবাস করলেও তার পরিবার ছিল কুমিল্লার রাজবাড়ী গ্রামে। এ গ্রামের স্কুলেই নাসিমার লেখাপড়া শুরু হয়। ছোটবেলায়ই নাসিমা তার বাবাকে হারান। তার পর মায়ের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার ভালো ছিলেন নাসিমা। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর নাসিমা বড় বোন জাহেরা খাতুনের বাড়িতে চলে আসেন। পিতৃতুল্য বড় দুলাভাই হামিদুর রহমান মেধাবী শ্যালিকার ভালো পড়াশোনার জন্য আদমজী জুটমিল এলাকায় আদমজী হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানেও নাসিমা মেধার পরিচয় দেন অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন ও এইচএসসিতে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করেন প্রথম শ্রেণীতে। তার পর তিনি ব্র্যাকের পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সেলের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ব্র্যাকে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি এঞত স্কলারশিপ নিয়ে (চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এমএস এবং আগাখান স্কলারশিপের মাধ্যমে (এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) থাইল্যান্ড থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। দেশে ফিরে সর্ব প্রথম তিনি ব্র্যাকের সহযোগিতায় হাসপাতাল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন ও এর খসড়া তৈরি করেন। সেটি ১৯৯৬ সালের কথা। এরপর ২০০৮-০৯ সালে এ আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়।
কিন্তু ২০০৫ সালে ইমিগ্র্যান্ট ভিসা নিয়ে কানাডার টরেন্টো শহরে যাতায়াত শুরু করলেও বর্তমানে ওখানেরই স্থায়ী বাসিন্দা। সেখানে তিনি মানবতার সেবার লক্ষ্যে গত ২০১০ সাল থেকে ‘বাংলাদেশী কানাডিয়ান কমিউনিটি সার্ভিসের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানে একদল স্বেচ্ছাসেবী তরুণ-তরুণী কানাডায় আসা নতুন আগন্তুকদের নানাভাবে সেবা দিয়ে থাকেন; যাতে বিদেশ বিভূঁইয়ে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারেন, যেকোনো ধরনের চাকরি, ট্রেনিং, পরামর্শ, উপদেশ গ্রহণ করে নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ড. নাসিমা আক্তার এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই ড. নাসিমা আক্তার পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। গান-গাওয়া ও কবিতা লেখা ছিল তার শখ। সেলাই ফোঁড়াই থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি জানেন না। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় তিনি সবসময়ই স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অত্যন্ত ধার্মিক এই নারী সারাজীবনই জনসেবায় নিজের জীবনকে নিবেদিত করে গেছেন। তাই তো তিনি বাংলাদেশে হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পড়াশোনা করে তা বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করেছেন কাগজে-কলমে।
আমাদের কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ও সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একজন নারীর ভূমিকা কতটা গ্রহণযোগ্য বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যোগ্যতা ও মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। তবে যোগ্যতানুসারে নারী-পুরুষের আলাদা কিছু দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। যেমনÑ একজন মা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। বাবা শুধুই চাকরি করবে মা ঘর-গৃহস্থালি সামলাবেÑ এমন ধারণা আজকের দুনিয়ায় বদলে গেছে। তবে স্ত্রী বা মা হিসেবে নারীর যেমন দায়িত্ব সে কাজকে অবহেলা করা যাবে না। বরং এর প্রতি কমিটেড হতে হবে। পরিবারের দায়িত্বে যতœবান হলে পেশাজীবী নারীর জীবনে পরিবার থেকে প্রতিবন্ধকতা আসার সম্ভাবনা কম থাকে এবং পরিবারের সহযোগিতা পেলে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়। নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই তিনি জানান, প্রতি বছরের বাজেটে জেন্ডার ব্যালেন্স সুযোগ থাকা উচিত। মেয়েদেরও তাদের অধিকার এবং প্রয়োজনীয় সাপোর্ট সম্পর্কে সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। নারী উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর অগ্রগতি যাচাই করতে হবে। আমাদের দেশে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা বরাদ্দ থাকলে ও তা নারীদের জন্য কতটা সহায়ক, এটা পরিষ্কার নয়। বাস্তবে নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তা প্রশংসনীয়। আমাদের মেয়েরা নিজেরাই অনেক উন্নতি করছে। নারী কর্মীদের মধ্যে কনফিডেন্স ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্যাপাবিলিটি বেড়েছে। কর্মজীবী নারীরা মা হিসেবেও সন্তানদের কাছে অধিক সম্মানিত হন। মায়ের আয়ে সন্তানের শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টি সহজ হয়।
৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসÑ এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি জানান, বছরের এই একটা দিনকে পুঁজি করে নারীদের বছরের বাকি দিনগুলোকে আলাদা করতে চাই না। বরং ভবিষ্যত প্রজন্মের নারীদের এই একটা কথা বলতে চাইÑ আমাদের মেয়েরা আজ সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি সেক্টরে দক্ষতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আজো সব ক্ষেত্রে পুরুষই নীতিনির্ধারণ করছে, সুতরাং নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য নারীদের সুযোগ করে নিতে হবে। নারীদের রাজনীতি-সচেতন হতে হবে এবং পার্লামেন্টে তাদের ভূমিকা সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে। নতুন প্রজন্মের নারীদের অংশগ্রহণে সবই সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সুখী দাম্পত্য জীবনযাপন করছেন স্বামী সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কানাডা প্রবাসী এই নারী সুযোগ পেলেই দেশে চলে আসেন। বিদেশে থেকেও বাঙালি নারী-পুরুষ সবার সুযোগ-সুবিধা দানে নিজের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় করছেন নিঃস্বার্থভাবে।
সাক্ষাৎকার : আঞ্জুমান আরা বেগম

গত ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারীশ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, অতিরিক্ত কাজ ও কাজের অমানবিক পরিবেশের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার বাহিনীর দমনপীড়ন। ১৯০৮ সালের একই শহরের সোস্যাল ডেমোক্র্যাট নারী পক্ষ থেকে আয়োজিত হয় সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এতে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর নেতৃত্ব দেন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। তার এ প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করে। ১৯১১ সাল থেকে
এ দিবসটি পালিত হয়।
প্রতি বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ভাবনা থাকে। এবারো আছেÑ ‘ভাবি সমান, হই চৌকস বদলায় নতুনে।’ লড়াই করেই নারীদের টিকে থাকতে হবে। ঘর-বাহির একসাথে সামলাতে হয়। তাই তাদের তো চৌকস হতেই হয়। তাই প্রতিবার নারী দিবসে আমরা সফল নারীর গল্প ছাপি। তাই বলে কি নারীদের বঞ্চনা নেই? আছে। তার পরও এসব উঠে আসার গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে।


আরো সংবাদ



premium cement