২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কৃষিতে নারীর অবদান

কৃষিতে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের সমান শ্রম দিয়ে থাকে -

আমাদের দেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আর নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুল সংখ্যক নারীশ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও হয় না। তাদেরকে এই স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। বরং তারা সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
গ্রামে বসবাসরত প্রতিটি নারীই নিজ নিজ পরিবারে কৃষি ও কৃষিকাজের সাথে জড়িত। প্রত্যক্ষভাবে কৃষিখামার কিংবা কৃষিজমিতে কাজ করা নারীর সংখ্যা কম হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক নারীকে এই খাতে শ্রম দিতে হয়। পারিবারিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদার কারণে নারীরা নিজের ঘরে কিংবা খামারে পরিশ্রম করলেও তা প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। গ্রামের প্রতিটি পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা কোনো না কোনোভাবে কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। কিন্তু ব্যাপারটি খুব একটা প্রকাশ্যে আসে না। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক
প্রতিবন্ধকতা কাজ করে।
বায়রা এলাকার বিধবা রোকিয়া বেগম জানান, পরিবারে অভাব-অনটনের জন্য নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। স্বামী মারা গেছে প্রায় ১০ বছর আগে। নিজেদের কিছু জমি ও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সবজি আবাদ করে বেশ সুখেই আছেন। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজে সহযোগিতা করে ছেলে রাকিব। এক মেয়ে এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। কৃষিখাতে আয়ের টাকা থেকেই চলছে তাদের সংসার এবং সন্তানাদির পড়াশোনা।
বরাইদ এলাকার হরেন্দ্র পালের স্ত্রী আরতি পাল। তিন সন্তানের জননী আরতি জানান, কৃষিপ্রধান পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বিয়েও হয়েছে কৃষকের সাথে। বাড়িতে তিনটি গরু পালন করেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আর দুই ছেলে পড়াশোনা করে। গৃহস্থালি কাজ শেষে ক্ষেত-খামারের কাজেও সহযোগিতা করেন তিনি। একসময় কৃষিকাজে লজ্জা ও কষ্ট হলেও এখন আর তেমন কষ্ট হয় না বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই বলেও জানান এই নারী।
ঘিওর উপজেলার বরটিয়ার ফরিদা আক্তার জানান, কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করেই তাদের সংসারজীবন। অল্প কিছু জমিতে ধান চাষ করে বাকি তিন বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেন। পরিবারের কাজকর্ম শেষ করে তিনি নিয়মিত স্বামীকে কৃষিকাজে সাহায্য করেন। এতে বাড়তি শ্রমিকের তেমন প্রয়োজন হয় না।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন বানু বলেন, কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিতে গ্রামীণ নারীরা আরো আগ্রহী হবেন। ফলে কৃষিখাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে। তাই কৃষিকাজে জড়িত নারী শ্রমিকদের মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবেন এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরো বাড়বে।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় জানান, গ্রামের প্রতিটি পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা কোনো না কোনোভাবে কৃষিকাজে জড়িত। কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়ন হয় না। তাদের এই স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। বরং তারা সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বৈষম্য দূর করে তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করলে কৃষিখাতে উৎপাদন, আয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরো জানান, কৃষক ও কৃষাণীদের কাজের সম্মান ও কৃষিতে আধুনিক প্রশিক্ষণ আর তাদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা করে আসছে বারসিক। এতে প্রান্তিক কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন।
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম জানান, মানব জাতির আদি পেশা হচ্ছে এই কৃষি। সভ্যতার সূচনাতে মানুষ প্রথমেই মাটিতে ফসল চাষ করা শেখে। আর এই কৃষির উৎপত্তি হচ্ছে নারীদের হাত ধরেই। দেশে বিভিন্ন পেশায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা যেভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, কৃষিখাতেও ঘটছে তাই। এই ধারার অবসান হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement