১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোশাক কন্যারা

-

ঘড়িতে তখন রাত ৮টা ১৪ মিনিট। আমি তখন সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি। চার দিকে তাকাতেই দেখা গেল রাস্তার দুই পাশে সারি সারি হেঁটে যাচ্ছে পোশাক বালিকারা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কেউ কেউ বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেলাম।
১.
সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ২০-২২ বছরের ছেলেটি। মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। একটু কথা বলা যাবে, জি। কারো জন্য অপেক্ষা করছো। হ্যাঁ, বোনের জন্য। সাথে সাথে বোন আসে। ওর নাম বিপ্লব, বোনের নাম নাবিলা। দু’জন দুই গার্মেন্টে কাজ করে। বিপ্লব পাঁচ বছর ধরে আছে সাভারে। গ্রামে মা আর ছোট বোন ছিল, দুই বছর আগে বোনের জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করে। সেই থেকে মা আর বোন সাভারের আরাপাড়ায় থাকে। নাবিলা বলে, ‘আগে অনেক কষ্ট হতো হেঁটে আসতাম দুই ভাইবোন। চার মাস আগে এই আধা পুরনো সাইকেলটা কিনি দুই ভাইবোন মিলে। এখন একসাথে সাইকেলে চড়ে আসি, ‘আবার সাইকেলে চড়ে যাই বাসায়।
২.
বাসের জন্য অপেক্ষা করছে বিলকিস। সামনে গিয়ে কথা বলতে চাইলে হেসে বলে, ‘আমার সাথে আবার কিসের কথা।’ বিলকিসের হাতে চার বাটির একটা টিফিনকারির সেট। প্রশ্ন এটা নিয়েই। এত বড় টিফিনকারিতে করে কী নিয়ে আসো? বিলকিস পাশের গার্মেন্টে কাজ নেয় দেড় বছর আগে। একই ঘরে বিধবা বোনসহ থাকে। বোনের বাচ্চা আছে বলে কাজ করতে পারে না। তবে বিলকিসের সাথে কাজ করে এমন তিনজনের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসে বিলকিস বাসা থেকে। বিধবা বোন রান্না করে দেয়। মাস শেষে অফিসের সেই তিন শ্রমিক হিসাব করে কিছু টাকা দিয়ে দেয়। সেই টাকা পায় বিলকিসের বিধবা বোন। বিলকিসের বাসা রেডিও কলোনি থেকে ভেতরের দিকে।
৩.
মাথায় কাপড় দিয়ে অনেকটাই গোমটা দেয়া নাহিদার। কথা বলতে চাইলে প্রথমে একটু নিষেধ করে। অন্যরা কথা বলেছে, এমনটি বলার পর একটু দাঁড়ায়। মাত্র তিন মাস হয়েছে নাহিদা ঢাকায় এসেছে। অবশ্য দুই বছর আগে সে ঢাকার আজিমপুরে গৃহশ্রমিক হিসেবে তিন বছর থেকেছে। ভালো লাগে না বলে গ্রামে যায়। গ্রামে অভাব লেগেই আছে। মা, ভাই আর ভাইয়ের বউদের কথা শুনতে হয় প্রতিমুহূর্তে। তাই বাধ্য হয়ে পাশের বাড়ির এক মহিলার সাথে চলে আসে সাভারে। সে মহিলা একটা ছোট কোম্পানিতে চাকরি করে। নাহিদাকে এই গার্মেন্টে কাজ নিয়ে দেয়। পাশের গার্মেন্ট আর ওর গার্মেন্টের ছয়জন মিলে ওরা একটা রুমে থাকে। সকালে ভাত খেয়ে আসে, দুপুরের জন্য একটু নিয়েও আসে। এখন বাসায় ফিরে রান্না করবে। একেক দিন একেকজনের রান্নার কাজ করতে হয়। ওরা যে বাড়িতে থাকে, সে বাড়িতে এমন পাঁচটা রুম, সব রুমে ওদের মতো মেয়েরাই থাকে। যারা টাকা বেশি দিতে পারে তাদের রুমে তিন-চারজন করে থাকে। চুলা দু’টি। বাড়িতে যত রুম তত ঘর হিসেবে রান্না করে। মোট ২২-২৩ জন হবে ওরা। সবাই বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। সবার মাঝে নাহিদাই নতুন। দ্রুত বাসায় না গেলে অন্যরা চিন্তা করবে বলে চলে যায়।
৪.
প্রায় ২৩-২৪ বছরের এক পোশাক শ্রমিককে দেখছি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে। ওর দিকে তাকিয়েই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। ও কি তাহলে...। আরেকটা মেয়ে হাত ধরে ধরে হাঁটছে। ওর বয়স হবে ১৫-১৬। কাছে গিয়ে কথা বলার অনুমতি চাই। তেমন বাধা দেয়নি। ওর নাম আকাশী। হাত ধরে যে আছে, তার নাম শেফালী। ওরা দুই বোন। থাকে সাভার ব্যাংক কলোনিতে। আকাশী আর ওর স্বামী হালিম আগে রানা প্লাজায় একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি করত। সেই দুর্ঘটনায় আকাশী একটা পায়ে আঘাত পায়। স্বামীর কী হয়েছে জানে না। আকাশীর পরিবার ভেবেছিল আকাশী মারা গেছে, কিন্তু অনেক দিন চিকিৎসা করার পর বেঁচে ওঠে। একটা মেয়ে আছে ওর। ঘরে মা আছে। মেয়েটা মায়ের কাছেই থাকে। দুই বোন এখন এখানকার একটা পোশাক কারখানায় কাজ করে। কথা শুনে কেমন যেন চেনা মনে হলো। ওরা কি তখন ব্যাংক কলোনির মাদরাসা মসজিদের উত্তর পাশে ছিল কি না বলাতে বলল, হ্যাঁ ছিলাম। বয়সী এক মহিলার বর্ণনা দিলাম। মিলে গেল। তার মানে ওরা আমার কিছুটা পরিচিত। পরিচিত বললে ভুলও হতে পারে। রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার প্রায় ৮-১০ দিন পর আমি সাভারে যাই। মা আর আমি বাসা থেকে কিছু দূরে যাচ্ছিলাম। এক বয়সী মহিলা ছোট একটা শিশুকে কোলে নিয়ে দ্রুত যাচ্ছে। মা জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছেন। বলল, মেয়ের খোঁজ পেয়েছি, ও নাকি হাসপাতালে আছে। মা শিশুটির হাতে কিছু টাকা দেয় আর মহিলাকে রিকশায় তুলে ভাড়া দিয়ে বলে, উনাকে এনাম হাসপাতালে নিয়ে যান। সব হিসাব মিলে যায়। এই আকাশীই সেই বয়সী মহিলার মেয়ে। যার খোঁজ পেয়ে সেদিন তিনি দ্রুত যাচ্ছিলেন।
আকাশী আর শেফালীকে রিকশায় যেতে বললাম। বললÑ লাগবে না, ধীরে ধীরে হেঁটেই যাবো। সারা দিন দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। এখন হেঁটে যাওয়া ভালো। হাঁটার দরকার আছেÑ এই বলে ওরা চলে গেল।
আমরা গাড়িতে উঠি। গাড়ি চলতে শুরু করল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের দিকে। রানা প্লাজার খালি জায়গার সামনে দিয়ে যখন যাচ্ছি, মনে হচ্ছে সেই চিৎকার এখনও কানে ভেসে আসে। ধীরে ধীরে পুরনো মার্কেট পার করে সামনে যাই।
ওরা কাজ করে, কাজের মূল্য হিসেবে মজুরি চায়। কখনো পায়, কখনো আবার তার ওপর ভাগ বসায় অন্য কেউ। দেশ কী পাচ্ছে ওদের কাছে, কী দিচ্ছে ওদেরÑ এত হিসাব ওরা বোঝে না। ওদের মতো হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রমেই আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, তার খবরও ওরা রাখে না। আমরা ওদের শ্রমিক বলি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলে তাকিয়ে থাকি। হয়তো কেউ ভাবি, কেউ ভাবি না।


আরো সংবাদ



premium cement