বিজয়ের আনন্দে ফিরি শিকড়ের কাছে
- রহিমা আক্তার মৌ
- ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান মতিন। যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের সময় তিনি পরিচিত ছিলেন কমান্ডার মতিন নামে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলেছেন তার মেয়ে রহিমা আক্তার মৌ
আমার বাবার নাম আবদুুল মান্নান মতিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বাবা যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের আগে থেকেই বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না, বাবার অফিসে অনেক কাজ। দাদী ভাবলেন, ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলে হয়তো গ্রামে বেশি আসবে। পাত্রী দেখে বাবাকে গ্রামে জরুরি তলব করলেন। ৩ ডিসেম্বর বাবাকে বিয়ে করালেন। নববধূ হয়ে মা ঘরে এলেন। বাবা মাকে বললেন, দেখো দেশের অবস্থা ভালো নয়; আমাকে শহরে থাকতে হবে। মা মনে করেন সন্তান বারবার গ্রামে আসবে। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি মাকে বুঝিয়ে রেখো।
যুদ্ধ শুরু হলো, প্রথম দিকে বাবা শহরে ছিলেন। এরপর চলে এলেন নিজ গ্রামে। যৌথ পরিবার আমাদের। বাবা যে গ্রামে আছেন তা জানতেন শুধু মা আর দাদী। বাবা চুপে চুপে গ্রামের যুবকদের অস্ত্র চালানো শেখাতেন। কয়েকজন করে শিখিয়ে তাদের নিয়ে যেতেন ক্যাম্পে। দলের অন্যদের কাছে তাদের পৌঁছে দিয়ে আবার গ্রামে ফিরতেন। এভাবেই কয়েকবার পৌঁছান। মুখোমুখি যুদ্ধে বাবা গুলি খেয়ে আহত হন। বাবার ওই আহত মন পড়ে থাকে যুদ্ধের গোলাবারুদের মাঝে। কোনো রকম সুস্থ হয়ে বাবা চলে যান যুদ্ধের ময়দানে। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করা নোয়াখালী চাটখিলের কমান্ডার মতিন নামেই বাবা পরিচিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীন দেশের বয়স এখন ৪৭ বছর। প্রতি বছর বিজয়ের দিন এলেই বাবা গ্রামে চলে যান, মেঠোপথ ধরে হাঁটেন। স্কুলের মাঠে বিজয়ের অনুষ্ঠান হয়, বাবা নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা বলেন। নতুন প্রজন্ম বাবার কাছে শোনে সেসব দিনের কথা। বয়স হয়েছে বাবার। দুই বছর ধরে বাবা গ্রামে যেতে পারেন না। আমরা ভাইবোনেরা সবাই নিজেদের ব্যস্ততা আর বাস্তবতার জন্য বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে। বাবা যেতে পারেন না গ্রামে, তাতে কি, আমরা পুরো পরিবার চলে যাই বাবার কাছে। বিজয়ের আনন্দ দেখি বাবার চোখে। আমরা সবাই যখন বাবার চারপাশে বসি, বাবা বলতে থাকেন সেই ’৭১-এর গল্প; বাবা বলতে থাকেন বিজয়ের দিনের গল্প। বাবা বলেনÑ
‘পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল ঢাকায়। আমরা তখন দুই নম্বর সেক্টরে। আমাদের ওপর নির্দেশ এলো আমরা যেন এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখি।’
এত বছর আমরা শুনেছি বাবার মুখে। এখন আমাদের পরের প্রজন্ম শোনে বাবার মুখে। এই তো গত বছর বাবা আমাদের শুনালেন ’৭১-এর ২২ নভেম্বরের কথা। বাবা বলেনÑ
‘সেদিন একসাথে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, রাত পোহালেই সবাই যাবো পোস্ট অফিসের পাশে। খবর আছে, পোস্ট অফিসে নাকি কিছু পাকবাহিনী লুকিয়ে আছে। যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। অল্প অল্প শীতের রাত, মধ্যরাতেই আমরা ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রওনা দিই। কারণ দিনের বেলায় যাওয়ার চেয়ে রাতে যাওয়াই উত্তম হবে। সেই ১৩ জনের সাথে আমিও। অন্ধকার রাত, নিরিবিলি পরিবেশে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে যেন কান ঝালাপালা হয়ে যায় আমাদের। কখনো হেঁটে, কখনো হামাগুড়ি দিয়ে পথ অতিক্রম করছি। সবার মাথায় শুকনো পাতার একটা ছোট ঝোপ ছিল। কোনো আওয়াজ পেলে আমরা সবাই চুপ হয়ে থাকতাম। কেউ বুঝতেই পারত না এখানে মানুষ আছে, ভাবত গাছের পাতা পড়ে জমা হয়ে আছে। শেষ রাতের কিছু আগেই সেখানে পৌঁছে যাই। কেউ হাঁটুপানিতে, কেউ জঙ্গলে অপো করতে থাকি সকাল হওয়ার জন্য। কোনো ভয় ছিল না মনে। সকালে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা আসেন। শুরু হয় দুই পরে গোলাগুলি। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন সেদিন। দিন শেষে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে আমাদের কাছে। বিজয়ের আনন্দ আমাদের, কিন্তু ভাবনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। ওদেরকে কাঁধে করেই নিয়ে আসি আমরা। ক্যাম্পেই চিকিৎসা দেয়া হয় তাদের। চারপাশ থেকে তখন পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের খবর আসতে শুরু করে আমাদের কাছে। সবাই ঢাকার খবর শোনার অপোয় থাকতাম।’ বাবা আরো বলেনÑ
‘মূলত ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ওরা বুঝে যায় ওরা হেরে যাচ্ছে। আর সে কারণেই ১৪ ডিসেম্বর ওরা আমাদের ওপর হায়েনার মতো আক্রমণ করে।’
মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের এখন অনেক বয়স। কারণ দেশটার বয়স যে ৪৭ বছর। সর্বনি¤œ বয়স যে মুক্তিযোদ্ধার ছিল, তার বয়স এখন ৬৩-৬৪ বছর। তারা এখন আর ছুটতে পারছেন না বিজয়ের গল্প শোনাতে। তাতে কী? এখন আমাদেরকেই ছুটে যেতে হবে তাদের পাশে। এক সময় বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাবা ছুটেছেন গ্রামে তার শিকড়ের কাছে। এখন আমরা ছুটি আমাদের শিকড়ের কাছে, বাবার পাশে, একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে। একটি দেশের কাছে, বিজয়ের কাছে।