২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারীর জাগরণে বেগম রোকেয়ার বাণী

-

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তার মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরাণী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায় আবুল আসাদ ইবরাহীম সাবের এবং খলিলুর রহমান আবু জাইগাম সাবের।
বেগম রোকেয়ার জন্মলগ্নে মুসলমান সমাজ ছিল নানাবিধ কুসংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত তৎকালীন সমাজের অধঃপতনের জন্য বুঝেছিলেন, সমাজে নারীর উন্নয়নের জন্য প্রথমে দরকার কন্যাশিশুদের উন্নয়ন। বেগম রোকেয়ার লেখালেখিতে নারী মুক্তির প্রতিফলন দেখা যায়। বাংলার মুসলিম নারী জাগরণ, নারী উন্নয়ন ও নারী মুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া পুরুষশাসিত সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও কুসংস্কারে জর্জরিত অশিক্ষা ও পর্দার নামে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য নারীসমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। মুক্তির পথ দেখিয়েছেন উপমহাদেশের রণশীল মুসলিম সমাজের নারীদের। তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই নারীসমাজ নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে পারবে। নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
পুরুষের সমকতা অর্জনের েেত্র তিনি কখনো পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা ল্য যাহা আমাদের ল্য তাহাই।’ তিনি বুঝেছেন, প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষের সমতা অনস্বীকার্য। তিনি লিখেছেন, “দেহের দু’টি চুস্বরূপ, মানুষের সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দু’টি চুর গুরুত্ব সমান।”
সাহিত্যিক হিসেবে তৎকালীন যুগের প্রোপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারত মহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, The Mussalman, Indian Ladies Magazine প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে নবনূর পত্রিকায়। মতান্তরে, তার প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৯০২ সালে, চৈত্র ও বৈশাখ ১৩০৮-১৩০৯ (যুগ্মসংখ্যা) নবপ্রভা পত্রিকায়। সমকালীন সাময়িক পত্রে মিসেস আর এস হোসেন নামে তার রচনা প্রকাশিত হতো। রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারীশিক্ষার পে তার নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তার ধ্যানধারণা। বাল্যবিয়ে এবং বহুবিয়ে প্রথার বিরুদ্ধেও তার লেখনী ছিল সোচ্চার। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুরবস্থা এবং দৈহিক-মানসিক জড়ত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় যে শিক্ষা এ ধারণাই রোকেয়া তুলে ধরেন তীè ভাষায় ও তির্যক ভঙ্গিতে। এক প্রতিকূল সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের খণ্ড খণ্ড চিত্র ফুটে উঠেছে তার রচনায়। সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের দুর্দশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তার বহু প্রবন্ধ ও নকশাজাতীয় রচনায়।
রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে : মতিচূর (প্রবন্ধ, ২ খণ্ড: ১ম খণ্ড ১৯০৪, ২য় খণ্ড ১৯২২), Sultana’s Dream (নকশাধর্মী রচনা, ১৯০৮), পদ্মরাগ (উপন্যাস, ১৯২৪), অবরোধবাসিনী (নকশাধর্মী গদ্যগ্রন্থ, ১৯৩১) প্রভৃতি। এ ছাড়া আছে অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদ। Sultana’s Dream গ্রন্থটি রোকেয়া নিজেই বাংলায় অনুবাদ করেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে। এটি একটি প্রতীকী রচনা এবং এতে বর্ণিত Lady Land বা নারীস্থান মূলত রোকেয়ারই স্বপ্নকল্পনার প্রতীক। মতিচূর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন প্রভৃতি গ্রন্থে রোকেয়ার ঐকান্তিক স্বপ্নই এক অভিনব রূপ পেয়েছে। মতিচূর ২য় খণ্ডে আছে ‘সৌরজগৎ’, ‘ডেলিসিয়া হত্যা’ (মেরী করেলি রচিত Murder of Delicia, ১৮৯৬ উপন্যাসের গল্পাংশের অনুবাদ), ‘জ্ঞান-ফল’, ‘নারী-সৃষ্টি’, ‘নার্স নেলী’, ‘মুক্তি-ফল’ প্রভৃতি গল্প ও রূপকথা। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা তার অসংখ্য চিঠিপত্র রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। সে যুগের অভিজাত শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু রোকেয়া উপলব্ধি করেন, এ দেশের বেশির ভাগ মুসলমানের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করে এই ভাষাকেই তার বক্তব্য প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বাংলা ভাষার পে জোরালো বক্তব্য রাখেন, যা সে যুগের পরিপ্রেেিত ছিল দুঃসাহসিক কাজ।
অসচেতন নারীসমাজকে সচেতন করার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন, ‘ভগিনীরা! চু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।’ ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া বিধবা নারীদের কর্মসংস্থান, দরিদ্র অসহায় বালিকাদের শিক্ষা, বিয়ের ব্যবস্থা, দুস্থ মহিলাদের কুটির শিল্পের প্রশিণ, নিররদের অর জ্ঞানদান, বস্তিবাসী মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মুসলিম মহিলা সমিতি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’।
তৎকালীন বাংলার পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত মুসলিম নারীদের গৃহকোণের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ল্েয নারী উন্নয়নের ইতিহাসে এই সমিতির অবদান অপরিসীম। বেগম রোকেয়া ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় নারী সম্মেলনে পঠিত ভাষণে উদাত্তকণ্ঠে বলেছিলেন, “পৃথিবীতে সর্বপ্রথম পুরুষ-স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছিলেন হযরত মোহাম্মদ সা:।’ তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষা লাভ করা সব নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য।’ কিন্তু আমাদের সমাজ সর্বদা তাহা অমান্য করেছে।”
বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন তিনি। মৃত্যুর পর তার পৈতৃক স্থানে একটি স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তার অসামান্য কর্মের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর’ করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দূত হলেন উসাইন বোল্ট ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী! 

সকল