২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্বসেরা নারীর তালিকায় সীমা সরকার

মা সীমা সরকারের সাথে হৃদয় -

ভাগ্যহত এক মা সীমা সরকার। স্বামীর সংসারে নানা টানাপড়েনের মধ্যে সীমা সরকারের কোল আলোকিত করে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। মুহূর্তে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু জন্মের ছয় মাস পর তিনি বুঝতে পারেন ভুল চিকিৎসায় ছেলের কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে হয়ে গেছে। আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় ছেলেকে নিয়ে মনে পুষে রাখা সব স্বপ্নসাধ। কিন্তু আর দশজন মায়ের মতো তিনি ভেঙে পড়ে হাল ছেড়ে দেননি। আত্মবিশ্বাসী মহীয়সী এ নারী গতিহীন, অর্ধ-অবশ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে নিজের সব সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে সারাক্ষণ অক্লান্ত শ্রম আর মাথার ঘাম ঝরাচ্ছেন বছরের পর বছর। প্রতিবন্ধী ছেলেকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়া করতে থাকেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় অংশ নিয়ে ও নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে তোলায় সেই প্রতিবন্ধী ছেলে এখন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। একজন মায়ের এ ধরনের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বিবিসি কর্তৃক বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশী নেত্রকোনার সংগ্রামী নারী এ সীমা সরকার।
নেত্রকোনা পৌর এলাকার কুরপাড়ায় হৃদয় সরকারদের স্থায়ী বসবাস এবং জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা। মা-বাবা আর ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের সংসার। বাবা সমীরণ সরকার স্থানীয় একটি ইটভাটায় অল্প বেতনে চাকরি করেন। অভাবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। হৃদয় সরকারের জন্মের শুরুটা বড়ই করুণ ও কষ্টের। মা সীমা সরকার প্রথমবারের মতো প্রসব ব্যথা নিয়ে নেত্রকোনা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে যান। অনাগত সন্তানকে নিয়ে তার দু’চোখ ভরা অনেক স্বপ্ন। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশুটি সঙ্গাহীন ছিল। তখন ডাক্তাররা শিশুটিকে মেয়াদউত্তীর্ণ ইনজেকশন পুশ করে। এ ভুল চিকিৎসার কারণে হৃদয়কে জন্মের পর থেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। অসুস্থতা ধরা পড়ার পর সন্তানের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার আশায় সব খুইয়ে কত ডাক্তার, হাসপাতাল এমনকি ভারতে নিয়েও চিকিৎসার জন্য বহু চেষ্টা করার পরও সব পরিশ্রমই বৃথা হয়। সেখানকার ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন, ভুল চিকিৎসার কারণে তার এ করুণ অবস্থা। যা আর কখনো ভালো হওয়ার নয়। এ কথা শোনার পর মা সীমা সরকার দু’চোখের জলে বুক ভাসালেন, কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। বুকের ভেতরের দুঃখ-কষ্ট চেপে তার সন্তানকে নিয়ে আবারো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তিনি পণ করলেনÑ আর দশটা ছেলের মতো পড়ালেখা শিখিয়ে তাকেও মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন। সেই থেকেই সীমা সরকারের সংগ্রামী জীবনের পথচলা।
ছয় বছর বয়সে হৃদয়কে কোলে করে বাড়ির পাশের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। নিয়মিত কোলে নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা। সময় গড়িয়ে এক সময় সেখানকার পাঠ চুকিয়ে নেত্রকোনা আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর রিকশা ও কোলে করে নিয়ে আসা-যাওয়াতে মোটেই ক্লান্তি বোধ করতেন না সীমা সরকার। হৃদয় নিজেও তার অসহায়ত্ব ভুলে অবসর সময়ে সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠত। তা যেমন-তেমন খেলা নয়Ñ ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় অংশ নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করত। তার কোমর থেকে অবশ থাকায় বসে বসেই বন্ধুদের সহায়তায় খেলায় মেতে উঠত। আর অদূরে তার মা সীমা সরকার কখনো দুঃখে আবার কখনো আনন্দে নীরবে আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া দু’চোখের অশ্রু মুছতেন। পড়ালেখার মতো খেলাধুলায়ও তিনি উৎসাহ দিতে থাকেন। ২০১৬ সালে সরকারি গার্লস হাইস্কুলে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে মায়ের কোলে চড়ে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আবু আব্বাছ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করার পর নাঈম নামের এক পরিচিত শিক্ষার্থীর সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সময় সীমা সরকারের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পরীক্ষার হলে কোলে করে নেয়ার সময় এম এ আল মামুন নামে ঢাকা বিশ্ব¦বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর নজর পড়ে যায় এ অভাবনীয় দৃশ্য। শখের বসে ওই ছবি তুলে সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমে পোস্ট করে দেন। আর তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। শেষে হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তির সৌভাগ্য অর্জন করেন।
বিশ্বের ৬০টি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে বিবিসি চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর ২০১৮ সালের ১০০ নারীর তালিকা তৈরি করেছে। ওই তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য পরিবারের নারীদের স্থান রয়েছে। সেখানে নেত্রকোনার সীমা সরকার ৮১তম স্থান অর্জন করেছেন।
হৃদয় সরকার এখন আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। সে মনে করে, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা নয়। অভীষ্ট লক্ষ্য ও মায়ের অনুপ্রেরণা, আত্মত্যাগ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আজ সে এত দূর আসতে পেরেছে। যদি শুরুতেই হতাশ হয়ে তার মা হাল ছেড়ে দিতেন, তবে হয়তো চার দেয়ালের মধ্যেই তাকে দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হতো। আলোর দিশারি সীমা সরকার এক দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো অটল থেকে বহু সাধনার পর এখন তিনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠেছেন। এ সফলতায় তিনি সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছেন। তিনি কখনো কল্পনাও করেননি বিশ্বের সেরা নারীদের তালিকায় স্থান পাবেন। যা আজ কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। এ এক অভাবনীয় ঘটনা।
হৃদয়ের স্কুলজীবনের সহপাঠী বিএ অনার্সের শিক্ষার্থী এহতেশামুল হক নাবিল বলেন, আমাদের অনেকের প্রায়ই ক্লাস মিস হতো। নিয়মিত স্কুলে যেতে পারতাম না কিন্তু হৃদয়কে কখনো ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে দেখিনি। তার সময়জ্ঞান ও নিয়মানুবর্তিতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ ও একই সাথে মায়ের এ বিরল স্বীকৃতিতে হৃদয় সরকার আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘যুদ্ধ জয় করার পর যে অনুভূতি হয় সে রকম, যা বলে বোঝানো যাবে না।’ এক প্রশ্নের উত্তরে সে আরো জানায়, ‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একজন সফল কূটনীতিক হওয়া। নিজ দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে সফলতার সাথে পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় ও প্রভাব বিস্তার করা’।
সীমা সরকার বলেন, ‘আমি অভিভূত ও আনন্দিত, যা প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক কষ্টের পর এ অভাবনীয় স্বীকৃতি। যা কখনো কল্পনাও করেনি। আমি তো এ স্বীকৃতির জন্য কিছু করিনি, সন্তানের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যই মা হিসেবে শুধু কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি। তবে আমার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ছেলেকে বড় করার জন্য যত কষ্টই হোক না কেন, তা আমি করে যাবো। সবার কাছে দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করছি, আমার সন্তান যেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement