২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তৃণমূল থেকে উঠে এসেও বড় নেতৃত্বে যাওয়া যায় : নাদিয়া মুরাদ

ভিন দেশ
-

ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় কোচো গ্রামের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়ে নাদিয়া মুরাদ। বেড়ে ওঠেন সেখানকার সিনজার প্রদেশে। বর্তমানে বসবাস করছেন জার্মানে। নাদিয়া ইরাকি ইয়াজিদি মানবাধিকার কর্মী। ইয়াজিদি অধ্যুষিত মিনজারের এক পার্বত্য গ্রামে ছিমছাম পরিবেশে বসবাস করতেই তার বেশি ভালো লাগে। সেখানে থেকেই নাদিয়া মুরাদ, ইরাক যে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ তা ভালোভাবে লক্ষ করেন। প্রচুর মানুষ হত্যা নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই মানবাধিকার কর্মী। এসব অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখে তিনি মোটেই স্বাভাবিক থাকতে পারছিলেন না। তখন থেকেই ভাবতেন, এর একটা বিহিত করা দরকার, যাতে করে অত্যাচারী-নির্যাতনকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। তিনি দেখেন, শুধু ইরাকে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই মানবাধিকার বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ন্যায্য অধিকার ভূলুণ্ঠিত। তিনি দেখেন, সাধারণ মানুষের ওপর (ইরাকের) তথাকথিত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী অত্যাচার ও নির্যাতনের যে বীভৎসতা, তার সীমা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। অত্যাচারী হায়েনাদের দ্বারা অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার নানা বয়সী নারীর সংখ্যাও অগণিত। এ থেকে বাদ যাননি মানবাধিকার কর্মী নাদিয়া মুরাদও। ছোট্ট গ্রাম কোচোতে পরিবারের সাথে থাকাকালে ২০১৪ সালে একদিন ওই গ্রামে অতর্কিতভাবে ঢুকে পড়ে ইসলামি নামধারী তথাকথিত একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা। অস্ত্রের মুখে সেখানকারই একটি স্কুলে ঢোকানো হয় ওই গ্রামের প্রায় সবাইকে। তাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলিও চালানো হয়। তাতে প্রচুর মানুষ মারা যায়। তার মধ্যে রয়েছে নাদিয়ার ছয় ভাইও। এরপর নাদিয়াসহ বহু নারীকে একটি বাসে মসুল শহরে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। সেখানে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হয় নাদিয়াসহ নানা বয়সী মেয়েকে। শুরু হয়ে যায় করুণ পরিণতি। নাদিয়া মুরাদের মাথায় বুদ্ধি আসে, কিভাবে এখান থেকে সরে বা পালিয়ে যাওয়া যায়। এরপর অন্যদের মুক্ত করা যায়। সরে যাওয়ার আগেই জঙ্গিরা নাদিয়াকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। তাকে প্রহার করা হয়, জ্বলন্ত সিগারেটের স্যাঁক দেয়া হয়। একদিন সুযোগ পেয়ে সেখান থেকে (বন্দিশালা) পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ধরা পড়ে যান জঙ্গিদের নজরে। কেন তিনি পালাতে চেয়েছিলেন, এই জেদে তাকে মাসের পর মাস আটকে রেখে বহুবার ধর্ষণ করা হয়। এমনকি জঙ্গিদের মনোনীত লোককে বিয়ে করতেও বাধ্য করা হয়।
নাদিয়া চেয়েছিলেন, অন্য নারীদের নিয়েও সেখান থেকে পালানো যায় কিনা। তবে তার পক্ষে একদিন একাই পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয় এবং সেই সুযোগে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। একটি ভুয়া পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মসুলের এক মুসলিম পরিবারের সহায়তায় চলে আসেন ইরাকের কুর্দিস্তানে ইয়াজিদি আশ্রয়শিবিরে। সেখানে এসে তিনি জানতে পারেন, তার বহু আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করেছে তথাকথিত জঙ্গিরা। তাতে তিনি মন শক্ত রাখতে যারপরনাই চেষ্টা করেন। সেখান থেকে নাদিয়া জার্মানিতে তার বোনের কাছে চলে যান এক সহায়তা সংস্থার সহায়তায়। বিদেশে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্য হলো, জঙ্গিদের শায়েস্তার মাধ্যমে কিভাবে এ কাজে আত্মনিয়োগ করা যায়, সেই প্রত্যাশিত পথ বা সুযোগ বের করা। তিনি আত্মনিয়োগ করেন ‘আমাদের জনতার যুদ্ধ’ শিরোনামের একটি লড়াই বা সংগ্রামে। সেই লড়াইয়ে যে তার সফলতা, তা বিচারেই পেয়ে যান নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১৮। এর আগেও তার এ ধরনের পুরস্কার আরো আছে। ২০১৬ সালে পান শাখারোভা মানবাধিকার পুরস্কার। যা প্রদান করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। একই পুরস্কার পান তার বান্ধবী নামিয়া হাজি বাশার। এ ছাড়াও নাদিয়া মুরাদ কাজ করছেন জাতিসঙ্ঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবেও। জাতিসঙ্ঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে তিনি কাজ করছেন তাদের জন্য, যারা মানবপাচারের শিকার হওয়ার পর কৌশলে মুক্তি মিলেছে। মানবাধিকারকর্মী নাদিয়া মুরাদ লড়াই করে যাচ্ছেন সাধারণ ইয়াজিদিদের ওপর ইসলামি নামধারী তথাকথিত জঙ্গিদের হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতেও। ২০১২-’১৩ সালের দিকেও ইরাকে ইয়াজিদিদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি। এরই মধ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে নির্যাতিত এই সম্প্রদায়ের প্রায় এক লাখ মানুষ। নাদিয়া বলেন, আমাদের এক করতে পেরেছে আমাদেরই জনতার নিঃস্বার্থ লড়াই। আমরা সবাই এ পথেরই পথিক। তিনি আরো বলেন, কে বা কারা ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হলো সেটি বড় কথা নয়, কারা এসব করছে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি আন্তর্জাতিকভাবেই। তিনি মনে করেন, যারা আন্দোলন করে যাচ্ছে মিয়ানমারের মতো দেশে, তারাও এসব শুনে আন্দোলনে সব ধরনের শক্তি বেশি পাবে। এভাবে বিশ্বে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়বে ছাড়া কমবে না। জাতিসঙ্ঘের ‘ফর দ্য ডিগনিটি অব হিউম্যান ট্রাফিকিং’-এর পক্ষেও কাজ করে যাচ্ছেন নাদিয়া। নাদিয়া মুরাদের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য লাস্ট গাল’ শিরোনামে। তার জীবনের যত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন বইটিতে। এর উদ্দেশ্য হলো, এ সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে মানুষের যথাযথ ধারণা বৃদ্ধি পাক। দেখা যাচ্ছে, নাদিয়া মুরাদ প্রথম ইরাকি নোবেল বিজয়ী। আর শান্তিতে নোবেল পাওয়া দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ইনেসিয়েটিভ নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। গণহত্যা, গণনির্যাতন, মানবপাচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের জীবন ও সম্প্রদায়কে সুন্দর জীবন কায়েমের ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে জার্মানের বেডেন-রিটেনবার্গ নামক একটি রিফিউজি কর্মসূচিতে তিনি এ সংক্রান্ত ব্যাপক সুবিধা নিশ্চিতের এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন। জার্মানের ওই শিবিরটিই তার নতুন আবাসস্থল হয়। ২০১৫-এর ১৬ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে মানবপাচার ও যুদ্ধ নিয়ে নাদিয়া গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। সেখানে এটিই ছিল তার প্রথম বিবৃতি। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, নাদিয়া মুরাদ তার নাদিয়া ইনেসিয়েটিভ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে তার উদ্যোগের ঘোষণা দেন। উদ্যোগের মধ্যে রয়েছেÑ গণহত্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের আইনি সহায়তা ও অপরাপর অন্যান্য সহযোগিতা দেয়া। ভ্যাটিকান থেকে সংখ্যালঘুদের জন্য যে সহায়তা আসে তার প্রাপ্তি স্বীকার তিনিই করেন। ইরাকে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে নিয়েও প্রসঙ্গ তোলেন নাদিয়া। অধিকন্তু, ইরাক ও সিরিয়াতে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তা নিয়ে তুলে ধরেন বাস্তব চিত্র। একই সাথে বহিরাগত এবং ইরাক ও সিরিয়া উভয় দেশের স্থানচ্যুত ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়েও আলোচনা করেন এ নোবেলজয়ী। মানবহিতৈষী এসব কাজ করতে গিয়ে নাদিয়া মুরাদ নানা সময়ে জীবননাশের হুমকিও পেয়েছেন। তার পরও তিনি সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ঠিকই অগ্রগতির পথে এগোতে থাকেন তার বুদ্ধি ও কৌশল কাজে লাগিয়ে। অথচ তিনি একজন কৃষক পরিবারের মেয়ে। তিনিই এখন পরিচিতি পান ইয়াজিদি জনতার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। নাদিয়া বলেন, তৃণমূল থেকে উঠে এসেও বড় নেতৃত্বে যাওয়া যায়। এ দিকে সচেতন মহল বলছে, যৌন নিপীড়ন বা সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার হিসেবে নাদিয়া মুরাদের নাম এমন সময় ঘোষণা করা হলো, যখন সারা বিশ্বে প্রথম পালন করছে যৌন নিপীড়নবিরোধী ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলন। এতে হয়তো আরো বেগবান হবে এ আন্দোলন।


আরো সংবাদ



premium cement
গাজা ইস্যুতে ইউরোপের নীতির সমালোচনায় অ্যামনেস্টি রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ : নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৩৩ জন গ্রেফতার বিপজ্জনক মাত্রার অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে বাঁচবেন কিভাবে বিয়ের বাজার শেষে বাড়ি ফেরা হলো না চাচা-ভাতিজির প্রধানমন্ত্রী আজ থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন ভারতীয় ৩ সংস্থার মশলায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান সাবেক শিবির নেতা সুমনের পিতার মৃত্যুতে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের শোক গণকবরে লাশ খুঁজছেন শত শত ফিলিস্তিনি মা ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আলোচনায় নেতাদের ভাই-বোন ও সন্তান সংখ্যা চীনে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা, ঝুঁকিতে ১৩ কোটি মানুষ

সকল