২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যতেœ থাকুক প্রবীণরা

আমেরিকা প্রবাসী জাহেরা বেগম তার তিন মেয়ে, তিন ছেলে ও পুত্রবধূর সাথে -

গত ১ অক্টোবর ছিল প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসঙ্ঘ প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯১ সাল থেকে সারা বিশ্বেই প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দিবসটি পালন হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন হয়।
বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে সেভাবে পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের এক কোটি ২৫ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ ষাটোর্ধ্ব বলা হয়। এখানে প্রবীণ নারী কত তা আলাদা করে বলার উপায় নেই। অথচ এই নারীরাই চেঞ্জমেকারের দায়িত্ব পালন করেন। সন্তানদের মানুষ করেও তাদের কাজ শেষ হয় না। বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে অনেক প্রবীণ নারীকেই ছেলেমেয়ের সংসার, তাদের সন্তানদেরও সামলাতে হয়। যদিও এই বয়সে তাদের প্রয়োজন বাড়তি সেবা যতেœর। কিন্তু ন্যূনতম সেবাটুকুও পান না অনেকেই। আবার অনেক প্রবীণ নারী ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে সুখে আছেন পরিবারের মধ্যমণি হয়ে। তেমনি একজন আমেরিকা প্রবাসী জাহেরা বেগম।
জাহেরা বেগমের বয়স এখন ৭৭। জাহেরা বেগমের স্বামী ছিলেন আদমজী জুটমিলের কর্মকর্তা। তার পাঁচ মেয়ে ও তিন ছেলে। তিনি তার সব ছেলেমেয়েকেই শিক্ষাদীক্ষায় আদর্শ মানুষ করে তোলেন। জাহেরা বেগমের দুই সন্তান ছাড়া সব ছেলেমেয়েই এখন আমেরিকা প্রবাসী, তা-ও ৩৩ বছরের বেশি হবে। প্রথম, মেজো মেয়ে শামসুন্নাহার স্বামীর সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমান, তারপর ধীরে ধীরে তিন ছেলে আর দুই মেয়ে এবং জাহেরা বেগম নিজেও ১৯৮৭ সাল থেকে আমেরিকায় প্রবাস জীবনযাপন করছেন। ছয় ছেলেমেয়ের ঘরে ১৩ জন আদরের নাতি-নাতনী তার। ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। ছেলেদের বউ ও মেয়ের জামাইরা সবাই কর্মব্যস্ত জীবনযাপন করেন। মেজো মেয়ে ও মেজো ছেলের হোটেল ও গ্যাস স্টেশনের ব্যবসা। বড় ছেলে ও ছোট ছেলে চাকরি করেন। ছোট ছেলে থাকেন ফ্লোরিডা এবং মেজো মেয়ে ও মেজো ছেলে থাকেন ওহাইও কলম্বাসে। বাকিরা থাকেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায়। মেজো মেয়ের মেয়ে লিন্ডা আইনজীবী; তার স্বামী হাসনাত চিকিৎসক। বড় ছেলে আফনান হক জনি ফার্মাসিস্ট; তার বউ পেশায় চিকিৎসক। জাহেরা বেগমের অন্যান্য নাতি-নাতনী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সবাই ওয়েল স্টাবলিশ। এদের সবাইকে নিয়েই জাহেরা বেগমের জীবন। তিনি ধার্মিক ও সহনশীল একজন নারী। তিনি কখনো কারো দোষ খুঁজে বেড়ান না। সারা বছর তিনি হাসিখুশি ও আনন্দফুর্তিতে ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে বেড়ান। তার জন্য সব ছেলেমেয়ের বাড়িতে আলাদা বিছানা সাজানো থাকে।
তিনি যখন যার বাসায় যেতে চান, ইচ্ছেমাত্রই ব্যবস্থা হয়ে যায়; অর্থাৎ যে কেউ এসে তাকে নিয়ে যান। বেড়াতে যান প্রতি সপ্তাহে বা ১৫ দিন পরপরÑ হয় বাইরে অথবা আত্মীয়-পরিজনের বাসায় অথবা বছরান্তে বাংলাদেশেও চলে আসেন বড় মেয়ে নুরুন্নাহার ও ছোট মেয়ে কামরুন্নাহারের কাছে। তারা দু’জনই স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে বসবাস করেন। জাহেরা বেগম সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। দেখে যান আত্মীয়-পরিজনদের। প্রবাস জীবনে কেমন আছেন? জাহেরা বেগমের কাছে জানতে চাইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি জবাব দেনÑ আমেরিকায় থাকলেও ঘরের ভেতরে আমি পুরো বাংলাদেশের আদলে কাটাচ্ছি। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, মেহমানদারি, আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি সবই বাংলাদেশের মতো চলছে। সুতরাং বোরিং বা একঘেয়ে জীবনযাপন বলে কিছু মনে হয় না। আমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী সবাই যে যখন পারে আমাকে সময় দেয়। আমি বুঝি সবার সুবিধা-অসুবিধা। কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ বা অভিমান নেই। আমি সারা দিন নামাজ-কালাম নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। বাকি যেটুকু সময় থাকে, সেটি ফোনে দেশের ভাগ্নি-ভাগ্নে, ভাইঝি-ভাইপো, আত্মীয়দের সাথে ফেসবুক/ভাইবার/ইমো দিয়ে কথা বলি। খবর নিই সবার। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি খুব ভালো আছি। আমার তেমন কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং বৃদ্ধ বয়সে মানুষের যেসব সমস্যা দেশ-বিদেশে দেখতে পাই, তা আমার নেই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আমি যেন এমনিভাবে বাকি জীবন আনন্দে কাটাতে পারি। প্রবাস জীবন ভীষণ রকম রোবটিক। এত ব্যস্ত সব মানুষ। সুন্দর জীবনযাপন করতে প্রত্যেক মানুষের প্রাণান্ত চেষ্টা আর এই সুন্দর জীবনযাপনের জন্য সবাইকে কাজ করতে হয় অনেক সময় ধরেÑ কি ঘরে, কি বাইরে। আমি এসব ৩০-৩২ বছর ধরে দেখে আসছি। তাই বুঝতে পারি কাউকে অযথা ব্লেম করতে হয় নাÑ কোন ছেলেমেয়ে আমায় বেশি দেখল, কোন ছেলেমেয়ে আমায় কম দেখল; বরং আমি সবাইকে নিয়ে কেমন ভালো থাকতে পারছি, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ভালো থাকা-মন্দ থাকা, সবই নিজের কাছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এখনো সুস্থ।
আমাদের সমাজে মানুষ এখন অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও ক্যারিয়ার সচেতন। যার কারণে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেন না। তাদের যে এ বয়সে বিশ্রাম-সেবাশুশ্রƒষা দরকার, সেটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। বৃদ্ধা রাশিদা বেগমের বয়স ৭২ বছর। তার চার ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে পিএইচডি হোল্ডার আমেরিকা প্রবাসী। মেজো মেয়ে পোল্যান্ডে। সেজো মেয়ে ফার্মাসিস্ট খুবই ব্যস্ত, গুলশানে থাকে।
রাশিদা বেগম ছোট ছেলের কাছে থাকেন। ছোট ছেলের দুই ছেলেÑ একজন চার বছরের, আরেকজন দুই বছরের। ছেলের বউ সরকারি আমলা। ছেলেও সরকারি বড় কর্মকর্তা। দু’জনেই খুব ব্যস্ত। বছরের অনেকটা সময় তাদের বিদেশে যেতে হয়। ফলে বৃদ্ধা রাশিদা বেগমকেই ঘরের কাজকর্ম এবং নাতিকে স্কুলে আনানেয়া করতে হয়। বাসায় ছোট্ট নাতিকেও দেখভাল করেন। ৭২ বছরের বৃদ্ধা শরীর-স্বাস্থ্যে সুস্থসবল দেখা গেলেও বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ হয়ে গেছেন। কোমর ব্যথা, পায়ে ব্যথা। চোখে কম দেখেন। ঘরে ছোট একটি কাজের মেয়ে আছে। ওকে নিয়ে তার সব করতে হয়। সেদিন তিনি বাথরুমে পিছলে পড়ে কোমরে ভীষণ ব্যথা পেয়ে বিছানা থেকে আর উঠতে পারেননি; তাই দুই নাতির সেবাযতœ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অগত্যা ছেলের বউ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সব কাজ করছিল আর সারা দিন বক বক করছিলÑ ‘আমি চাকরিও করব বুড়ো মানুষের সেবাও করবÑ যত্তসব জঞ্জাল আমার ঘাড়ে এসে পড়ছে।’ রাশিদা বেগম অন্য ঘর থেকে সব শুনতে পেয়ে কাঁদেন। বড় ছেলে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সেখানকার জীবন আরো বেশি বোরিং। সবাই যেন যন্ত্র। মেয়ের পোল্যান্ডের বাসায়ও একবার বেড়াতে গিয়েছিলেনÑ সারা দিন নির্জন ঘরে একা বসবাস করা। কথা বলার মানুষ নেই। এমন জেলখানায় থাকার চেয়ে দেশে একা থাকাও ভালো। কারণ, আত্মীয় পাড়া-পড়শির সাথে অন্তত দু-একটা কথাবার্তা বলা যায়। মাঝে মধ্যে ভাইবোন, ভাইপো, ভাগ্নেদের সাথে ফোনে কথা বলা যায়। নাতিদের নিজের হাতে যতœ করা। সারা দিন পর ছেলেটার মুখটা দেখে প্রশান্তি পাওয়া যায়। তিনি সারাজীবনই নিজের সন্তানদের ভালো থাকার জন্য নিজের দিকে একবারও তাকাননি। এখনো সংসারের জন্য প্রাণপাত করেন। তারপরও তিনি হয়েছেন জঞ্জাল।
প্রতি বছর প্রবীণ দিবস এলে প্রবীণদের ওপর পত্রপত্রিকায় লেখা, আলোচনা হয়। এরপর আবার প্রবীণরা চলে যান বিস্মৃতির অতলে। আমরা তাদের খোঁজ রাখি না। কিন্তু তারা সমাজের সিনিয়র সিটিজেন। একসময় সমাজকে অনেক দিয়েছেন। এখন এই বয়সে সম্মান ও মর্যাদার জীবনযাপন করা তাদের অধিকার। আমরা যেন সেটি নিশ্চিত করি।

 


আরো সংবাদ



premium cement